উপকূলের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেন মাসুম
শেখ নাসির উদ্দিন
চারপাশে পানি থাকায় বাঁধে অন্য সবার মত জায়গায় হয়েছে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রোকসানা বানুর। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান তার ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়েছে। তাই প্লাস্টিক কাগজের ছাউনিতে কোনমতে দিন কাটছে তার। পরিবারের সদস্য বলতে একমাত্র তিনিই। চুলা থাকলেও ঘরে চাল নেই। সেজন্য গত দু’দিন ধরে অনাহারে ছিলেন এ বৃদ্ধা। সাথে জ্বর আর কাঁশি।
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের অবস্থার খোঁজ নিচ্ছিলেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। বাদ যায়নি ওই বৃদ্ধার ঘর। স্বেচ্ছাসেবককে পেয়ে কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধা। তার কথা শেষ না হতেই ঘরে বেশকিছু দিনের খাবার আর ওষুধ পৌঁছে দিলেন সেই স্বেচ্ছাসেবক।
শুধু ওই বৃদ্ধা নন, আম্ফানের শুরু থেকে এমন অনেক মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন সাতক্ষীরার পাতাখালি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ। তার বাবা ছিলেন ওই মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। বড় পরিবার হওয়া সত্ত্বেও মাদ্রাসার অনেক শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন তিনি। বাবার এমন মানবিক কাজ তাকে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সব সময়।
পড়াশোনা শেষে মাদ্রাসা শিক্ষক হয়ে একটু একটু করে সামাজিক কাজে মন দেন। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু করেন ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার সময়। তারপর মাঝে অনেক ঘূর্ণিঝড় গেল। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। কখনো মানুষকে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা দেওয়া, আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর আর খুলনার কয়রার উপকূলবাসীর ঘরে ঘরে ১২৫ দিন ধরে খাবার সরবরাহ করেছেন তিনি।
এ ছাড়া শিশুদের বিনোদনের জন্য ফুটবল, ক্যারাম বোর্ড, চকলেট ও চিপস দিয়েছেন। এসব কাজের বিবরণ দিয়ে নিজের ফেসবুকে প্রতিনিয়ত ছবি ও ভিডিও আপলোড দেন। সেটা দেখে দেশের বিভিন্ন সংগঠন আর দানশীল ব্যক্তিরা মাসুম বিল্লাহর এ মহৎ কাজে সহযোগিতা করেন।
তরুণ স্বেচ্ছাসেবক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষের অসহায় অবস্থা দেখে কষ্ট হতো। তাই স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছি সব সময়। এ বছর করোনা যখন শুরু হয়; তখন মানুষকে সচেতন করি এবং দরিদ্র পরিবারে খাবার পৌঁছে দেই। তারপর এলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফান; তখন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া ও খিচুড়ি রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করি। উপকূলের বাঁধ ভেঙে গেলে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমার কাজকে সহজ করেছে। উপকূলের ক্ষতিগ্রস্তের চিত্র ফেসবুকে তুলে ধরার পর বিভিন্ন সংগঠন সাহায্যের হাত বাড়ায়। আমার কাজে এগিয়ে আসে আমার বন্ধু ও ছোট ভাইয়েরা। এবার ঈদে উপকূলের ১৭টি পয়েন্টে ঈদসামগ্রী ও ছোটদের কাপড় পৌঁছে দিয়েছি। এ ছাড়া কুরবানির ঈদে প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী গরুর মাংস বিলিয়েছি।’
মাসুম বলেন, ‘এখনো মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। এই তো সেদিন তিনশ পরিবারকে খাবার দিলাম। এখন উপকূলের জন্য প্রয়োজন ওষুধ। বেশির ভাগ মানুষ চর্মরোগ, ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছে। সাধ্যমতো ওষুধ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া সাত জনকে নৌকা আর আট জনকে নতুন ঘর তুলে দিয়েছি। আল্লাহ যতদিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন; ততদিন আমি স্বেচ্ছায় মানুষের সেবা করতে চাই।’
সরকার টেকসই বাঁধ নির্মাণ করলে উপকূলবাসীকে বছরে দুইবার পানিতে ডুবতে হবে না। অন্য সবার মত তিনিও চান উপকূলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হোক।
লেখক: ফিচার লেখক।
এসইউ/এএ/এমএস