বিসিএস ক্যাডার ইদ্রিসের মানবিক উদ্যোগ
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো অথবা মানবিক হওয়ার শিক্ষা বেশিরভাগ শিক্ষকই দিয়ে থাকেন। কিন্তু ক’জন শিক্ষক পারেন নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে? মানুষ যখন মানুষের জন্য তখন এমন শিক্ষক পাওয়া কঠিন কিছু নয়। তেমনই এক মানবিক কলেজ শিক্ষকের গল্প জানাচ্ছেন শেখ নাসির উদ্দিন—
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেছেন। দিনমজুর বাবার সাত সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটনে বেড়ে উঠতে হয়েছে। শত বাধা উপেক্ষা করে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাইভেট পড়িয়ে চালিয়েছেন নিজের পড়াশোনা। তারপর বিসিএস প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। প্রথমবারেই ৩৫তম বিসিএসে হয়ে যান শিক্ষা ক্যাডার। বলছিলাম সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলীর কথা।
সাতক্ষীরা জেলায় তার জন্ম। এখানেই বেড়ে উঠেছেন নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি পেরিয়ে। ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন আইলা, বুলবুলসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেখেছেন অসহায় মানুষের আর্তনাদ। তখন থেকে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছে ছিল তার। ছাত্র জীবনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ না থাকলেও শিক্ষক হওয়ার পর উপকূলবাসীর সেবক হয়ে কাজ করছেন হাজারো মানুষের জন্য। নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন সামাজিক সেবা সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’।
প্রভাষক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সন্তান। ছোট থেকে দেখছি উপকূলের মানুষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে বেঁচে থাকে। এখানে প্রায় সারাবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। মানুষ এখানে প্রকৃতির কাছে অসহায়। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য কাছ করছি।’
হিউম্যানিটি ফার্স্ট’র শুরুর গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখনো সংগঠনের কোন নাম ঠিক হয়নি। ২০১৮ সালে ১ বছরের অসুস্থ শিশুর বাবা সাহায্যের জন্য আসেন। তখন মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে পরিচিতদের অ্যাড করি। ১২ দিনের মধ্যে ১ লাখ টাকা জোগাড় করে দেই। এরপর আশাশুনির এক ভিক্ষুককে ২৯ হাজার টাকায় ঘর নির্মাণসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করি। এরপর ‘আগে মানবতা, পরে অন্য কথা’ স্লোগানে সংগঠনটি গড়ে তুলি। ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ আছে। যার মাধ্যমে সংগঠনের কর্মসূচির তথ্য তুলে ধরি। সংগঠনের কাজ দেখে দেশ-বিদেশের দানশীল মানুষ আর্থিক সহযোগিতা করে।’
হিউম্যানিটি ফার্স্ট শুরু থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শিক্ষা, চিকিৎসা, রক্তদান, সামাজিক সচেনতা, উপকূলের দুর্যোগ পূর্ববর্তী সর্তকবার্তা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। দরিদ্র শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র।
ইদ্রিস আলী আরও বলেন, ‘এবার হঠাৎ করেই আম্ফান এসে উপকূলের ঘর-বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পানিবন্দি হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও খুলনার কয়রা উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হয়। তখন আমাদের সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়ে রান্নাকরা খাবার ও সাত দিনের শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছি।’
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে তারা টেকসই উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছেন। দুর্ভোগ কমাতে বন্যাপ্লাবিত এলাকায় ১৫০টি চুলা দিয়েছেন। ৪০০ স্যানিটারি টয়লেট ও নিরাপদ পানির জন্য বেশ কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে বাঁশ দিয়েও সহযোগিতা করেছেন।
এ ছাড়া দুর্গত এলাকায় মাঝে মাঝেই ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করে বিনা মূল্যে ওষুধ দিয়েছেন। সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতেও ওষুধ দিয়েছেন। এমনকি ১২ হাজার খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে সহযোগিতা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাসিক অর্থ দিয়েছে হিউম্যানিটি ফার্স্ট।
মানবিক এ কলেজ শিক্ষক মনে করেন, উপকূলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ, সুন্দরবনকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলাসহ এলাকার মানুষের জন্য স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে উপকূলের মানুষের ভাগ্য ফিরবে।
এসইউ/এএ/জেআইএম