হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার তালগাছ
বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
চিরায়ত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য আর ‘এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ থাকা লম্বা লম্বা তালগাছগুলোর সম্পর্ক যেন একই সুতোয় গাঁথা। আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি তালগাছ সেই আদিকাল থেকেই গ্রামবাংলার শোভা বাড়িয়ে এসেছে। আর তালগাছের পাতায় বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা বাতাসে দুলে দুলে গভীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। তাই প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে রক্ষায় এবং শোভা সৃষ্টিতে তালগাছের জুড়ি মেলা ভার। তালগাছ শুধু শোভা ছড়িয়েই বসে থাকেনি। এর পাশাপাশি নিজেকে পুরোটাই বিলিয়ে দিয়েছে মানুষের নানা কাজে।
চিরকাল ধরেই তালগাছ তার বুক পেতে চিরসবুজ বাংলাদেশকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছে এবং বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার কমানোতেও রেখেছে অপরিসীম ভূমিকা। তাই সব সময় তালগাছ এবং এর বিভিন্ন অংশ জীবনের নানাবিধ চাহিদা মিটিয়ে এসেছে। যেমন- তালপাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, পুতুল ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড দিয়ে ভেলা বা নৌকা, ঘরের খুঁটি বানানো হয়।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই তালগাছ তার রস, ফল, বীজের শাঁস দিয়ে ভোজনরসিক বাঙালির রসনাবিলাস করে আসছে। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাসিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ অনেক খনিজ উপাদান। তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি, তাড়ি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে কাঁচা তাল ফলের শাঁস খাওয়ার জন্য চারিদিকে হাক-ডাক পড়ে যেত। চলতো শাঁস খাওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তালগাছের তলায় গেলেই পাকা তালের সুবাসে মন জুড়িয়ে আসত। এমনকি ভাগ্যে থাকলে দুই-চারটি পাকা তালও পাওয়া যেত। গাছ থেকে ধপাস ধপাস শব্দে তাল পড়লে তা দূর থেকেই শোনা যেত। এই সময় পাকা তালের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো প্রতিটি বাড়ি।
বাড়ির ঝি-বউয়েরা পাকা তালের আটি পিষে হলুদ রস বের করতো। এরপর সেই রস দুধ ও কোরানো নারকেলসহ জ্বাল দিয়ে ঘন করে অনেক সময় এমনি এমনি বা চিড়া-মুড়ি দিয়ে খাওয়া হতো। শ্রাবণ মাসে তালের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। শুধু তালের ভাজা পিঠাই নয়, তালের রুটি, তালের বড়া ও তালসত্বসহ আরও কতো বাহারী রকম পিঠা! মেহমানদারীতে সেসব পিঠা ছিল স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তাই এখনো তালের রস, শাঁস ও পিঠার কদর সারা বাংলাদেশেই আদি ও অকৃত্রিম।
পাম গোত্রের তালগাছ ৬০-৭০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এবং এর জীবনকাল প্রায় ১০০-১৫০ বছর। তালগাছ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অন্যতম পরিবেশবান্ধব, জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী গাছ। একসময় গ্রামবাংলার অধিকাংশ বাড়ি-ঘর, রাস্তা ও মাঠের আলে প্রচুর তালগাছ ছিল। তাই দূর থেকে কোনো বাড়ি বা স্থান চেনাতে তালগাছের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী তালগাছ।
আজ আর তেমন দেখা মেলে না তালগাছের পাতায় বাসা বানিয়ে হাজার হাজার বাবুই পাখির কিচির-মিচির ডাকের মনোরম দৃশ্য। তাই বর্তমানে দূর থেকে ‘ঐ দেখা যায় তালগাছের’ চিত্রপট কবিতার মাঝে কল্পনা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইদানীং বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেশ বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তালগাছের সংখ্যা কমে আসা। তাই পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষাসহ অন্যান্য উপকার পেতে তালগাছের চারা রোপণ ও সুরক্ষা করা ভীষণ জরুরি।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
এসইউ/এএ/পিআর