করোনা আক্রান্ত শিশুদের শরীরে যে জটিলতা দেখা দেয়
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ কেউই নিস্তার পাচ্ছেন না। প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটি মানবসভ্যতার কাছে অজানা হওয়ায় সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি, জটিলতা, প্রতিকার প্রভৃতি সম্পর্কে বিশদ ধারণা ছিল না। পরবর্তীতে যেমন কোভিড-১৯ এর নতুন নতুন রূপভেদ, লক্ষণ, জটিলতা ইত্যাদি শনাক্ত হয়েছে; তেমনি এর প্রতিরোধকল্পে সর্বাধিক কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টাও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একেবারে শুরুর দিকে ধারণা করা হয়েছিল, সংক্রমণটি প্রধানত বয়স্কদেরই হয়ে থাকে এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জটিল রূপ ধারণ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে এবং শিশুদের ক্ষেত্রেও সংক্রমণজনিত নানাবিধ জটিলতা তৈরি করতে পারে। মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোম-সি হলো শিশুদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের এমনই একটি দুর্লভ কিন্তু জটিলতর রূপ। তবে সব করোনা সংক্রমিত শিশুরই যে এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয়, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। কী কী কারণে কোনো কোনো করোনা সংক্রমিত শিশু মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছে, তা নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাস আক্রমণের পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একটু দেরিতে এবং প্রয়োজনের অত্যধিক আকস্মিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে কোনো কোনো শিশুর শরীরে এ ধরনের বিরল ও বিপজ্জনক জটিলতা দেখা যাচ্ছে। এ জটিলতায় আক্রান্ত মুষ্টিমেয় কিছু শিশুকে নিবিড় পরিচর্যায় রাখারও প্রয়োজন পড়ছে।
এ ধরনের জটিলতার জন্য সাম্প্রতিক কিংবা চলতি সময়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত শিশুর শরীরের দুই বা ততোধিক অঙ্গ যেমন- হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, বৃক্ক, চোখ, পরিপাকঅঙ্গ, চামড়া ইত্যাদিতে প্রদাহ দেখা দেয় এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন- সিআরপি, ইএসআর, ফেরিটিন, প্রোক্যালসিটোনিন, ডি-ডাইমার ইত্যাদির মাধ্যমেও এ প্রদাহের উপস্থিতি প্রমাণ করা যায়। অথবা কোনো শিশু যদি বিগত চার সপ্তাহের মাঝে কোনো সম্ভাব্য কিংবা নিশ্চিত করোনা সংক্রমিত রোগির সংস্পর্শে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে এবং বিভিন্ন অঙ্গে এ ধরনের প্রদাহের লক্ষণ দেখা যায়, তবে সেই শিশুও মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত বলে ধারণা করা যায়। সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু থেকে ষোলো বছর বয়সী টিনএজার পর্যন্ত জটিলতার এ নতুন ধারাটি পরিলক্ষিত করা হয়েছে।
জটিলতার প্রধান উপসর্গ হিসাবে দেখা যায় জ্বর। বিগত ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় যাবত শিশুর শরীরের তাপমাত্রা ক্রমাগত ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি থাকে। পাশাপাশি শিশু অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ঘাড়ে ব্যথা, তীব্র পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, অচৈতন্য, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চামড়ায় লাল লাল ছোপ দেখা যাওয়া, মুখমণ্ডল ও ঠোঁট নীলাভ হয়ে যাওয়া, ঠোঁট শুষ্ক হয়ে ফেটে যাওয়া, ঘাড়ের লসিকাগ্রন্থিগুলো ফুলে ওঠা, শরীর ফুলে যাওয়া, হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা উপসর্গে আক্রান্ত হতে পারে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, জটিলতায় আক্রান্ত বেশিরভাগ শিশুরই ‘কোভিড লাং’ তথা করোনা জনিত শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা তেমন একটা থাকে না। তবে মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোম-সি নামক এ জটিলতায় আক্রান্ত সব শিশুরই যে একই উপসর্গ দেখা দেবে তা কিন্তু নয়, আবার একজন শিশুর যে সব উপসর্গই দেখা দেবে এমনটাও নয়। রক্তপরীক্ষায় রক্তে নিউট্রোফিল, ল্যাকটিক এসিড ও এলডিএইচ এনজাইমের পরিমাণ বৃদ্ধি, এলবুমিন নামক প্রোটিন ও লিম্ফোসাইটের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি বিষয় শনাক্ত করা যায়। আবার এক্স-রে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষায় হৃৎপিণ্ড বিকলের উপস্থিতিও নিশ্চিত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাওয়াসাকি রোগের সাথেও মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোমের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে, যেমন উভয় ক্ষেত্রেই হৃৎপিণ্ডে রক্তসংবহনকারী করোনারি ধমনি প্রদাহজনিত কারণে ফুলে ওঠে। এজন্য এ জটিলতাকে কোনো কোনো বিজ্ঞানী কাওয়াসাকি ডিজিজ শক সিন্ড্রোম নামেও অভিহিত করেছেন।
তবে আশার কথা এই, যেসব শিশু এ জটিলতার শিকার হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছে এবং তারা সুস্থ হয়ে গেছে। আপনার শিশুর যদি এ ধরনের কোনো উপসর্গ দেখা যায়, তবে দেরি না করে যতদ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় বিভিন্ন জটিল ক্ষেত্রে বাচ্চাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। সময়মত যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ জটিলতার চিকিৎসায় বিভিন্ন সাপোর্টিভ চিকিৎসা যেমন- শরীরে তরলের ঘাটতি পূরণ ও শিশুর শ্বাসকার্যে সহায়তার পাশাপাশি প্রদাহ কমানোর জন্য ইমিউনোগ্লোবিউলিন ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধেরও প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনি আক্রান্ত হলে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
তাই দুশ্চিন্তা না করে সময়মত সঠিক চিকিৎসাই পারে এ জটিলতা থেকে শিশুকে সুস্থ করতে। পাশাপাশি শিশু যেন করোনা সংক্রমিত না হতে পারে সেজন্য কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিন। শিশুকে নিয়ে বাইরে অযথা ঘোরাঘুরি থেকে বিরত থাকুন। শিশুকে কোলে নেওয়ার পূর্বে ভালো করে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। পরিবারের কেউ করোনা সংক্রমিত হয়ে থাকলে বাড়ির শিশুকে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে পৃথক রাখুন। কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলে বারো বছরের বেশি বয়সী শিশুদের অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করুন। সম্ভব হলে বারো বছরের নিচের শিশুদের ‘বেবি মাস্ক’ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন। নির্দিষ্ট সময় পরপর সাবান-পানি দিয়ে শিশুর হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে দিন। বাসায় যেসব জিনিস বারবার ধরা হয়, যেমন- দরজার হাতল, সুইচ, লিফটের বাটন, সিঁড়ির রেলিং, চেয়ারের হাতল প্রভৃতি প্রতিদিন জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করুন। শিশুদের খেলার সামগ্রীও এ জীবাণুমুক্তকরণের আওতায় আসবে।
সর্বোপরি নিজে এবং শিশুসহ পরিবারের সবাইকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উৎসাহিত করুন। তাহলেই শিশুদের করোনাসহ এ মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোম-সি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সুস্থ থাকুন, করোনামুক্ত থাকুন।
> আরও পড়ুন-
প্রতিমুহূর্তে জীবাণুনাশক কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
করোনা: শিশুর প্রতি খেয়াল রাখবেন যেভাবে
বাইরে যাওয়ার আগে ভয়ঙ্কর তথ্যগুলো জেনে নিন
করোনা আক্রান্ত হলে কী করবেন?
কোনো উপসর্গ নেই, তবু করোনা হতে পারে?
করোনা: সুস্থ হওয়ার পরও আক্রান্ত হতে পারেন
এসইউ/এএ/জেআইএম