ইনসোমনিয়া হলে শরীরের যেসব ক্ষতি হয়
মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য একটি বিষয় হলো ঘুম। ক্লান্তি ভুলে পূর্ণোদ্যমে কাজ করার জন্য ঘুম আবশ্যক। সময়মত দু’চোখে যার ঘুম থাকে না, অনিদ্রা যার জীবনের কর্মস্পৃহা কেড়ে নিয়েছে; একমাত্র সে-ই হাড়েহাড়ে টের পায় নির্বিঘ্ন ঘুমের গুরুত্ব। ঘুম নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই চলুন ইতিহাসের একটু পেছনে ফিরে দেখে আসা যাক। আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগের কথা। সিলভানো নামে এক নৃত্যশিল্পী থাকতেন ইতালির ভ্যানিস শহরে। সালটা হলো ১৯৮৩। তার বয়স তখন ৫৩। হঠাৎ করেই তিনি লক্ষ্য করলেন, কয়েকদিন ধরে কিছুতেই তার আর ঘুম আসছে না। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর দিনের বেলায়ও তার চোখে একবিন্দু ঘুম নেই। তীব্র অনিদ্রায় অস্থির হয়ে শেষপর্যন্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। প্রায় চার মাস না ঘুমিয়ে থাকার পর তিনি কোমায় চলে যান, সেই ঘুম তার আর ভাঙেনি। অবশেষে ওই ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রাতেই তার মৃত্যু হয়।
সিলভানোর মৃত্যুতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন এক রহস্য উদঘাটিত হয়। আবিষ্কৃত হয় রহস্যময় এবং ভুতুড়ে এক প্রচণ্ড বিরল দুরারোগ্য ব্যাধি, যাকে বলে ফ্যাটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসোমনিয়া। সিলগভানোই ছিলেন এই রোগের প্রথম শনাক্তকৃত কেস। পরবর্তীতে গবেষণায় বেরিয়ে আসে আরও অনেক গা শিউরে ওঠা তথ্য। ধারণা করা হয়, এ ফ্যাটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসোমনিয়ার উৎপত্তি হয়েছিল কোনো এক ইতালীয় পরিবারে ১৭৬৫ সালের দিকে। পরবর্তী ২৫৫ বছরে সারা পৃথিবীতে জার্মান, ইতালিয়ান, আমেরিকান, ফরাসি, অস্ট্রেলিয়ান, অস্ট্রিয়ান, ব্রিটিশ ও জাপানিসহ মোট ৪০টি পরিবারের প্রায় ১০০ জনকে চিহ্নিত করা গেছে এ রোগের শিকার হিসেবে।
ফ্যাটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসোমনিয়া মস্তিষ্কের ক্ষয়কারী অপজাত সম্বন্ধীয় একটি জন্মগত অটোসোমাল ডোমিন্যান্ট জেনেটিক রোগবিশেষ। বাবা-মা এর যে কারো যদি একটি পিআরএনপি মারণ জিনের কপি থাকে, তাহলে সন্তান-সন্তুতিতে রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ শতাংশ। আমাদের মস্তিষ্কের প্রিয়ন রিলেটেড প্রোটিন নামক জিনে যদি মারণঘাতী কোনো বিবর্তন ঘটে, তাহলে স্নায়ু ধ্বংসকারী অস্বাভাবিক আকৃতির প্রিয়ন নামক এক বিষাক্ত প্রোটিনসত্ত্বা তৈরি হয়। শরীরের অনাক্রম্যতন্ত্রকে ফাঁকি দিয়ে এরা মস্তিষ্কে শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে মস্তিষ্কের থ্যালামাস নামক ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী অংশে এসব সংক্রামক প্রিয়ন প্রোটিন বেশি জমা হয়। এতে মস্তিষ্ক গঠনকারী নিউরন ধ্বংস হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক ঘুমের ছন্দ থেকে বঞ্চিত হন।
এ রোগের থাকে দীর্ঘ সুপ্তাবস্থা কিন্তু সংক্ষিপ্ত ক্লিনিক্যাল দশা, অর্থাৎ প্রিয়ন নামক অস্বাভাবিক প্রোটিনটি তৈরি এবং মস্তিষ্কে জমা হতে দীর্ঘদিন সময় নেয়। কিন্তু একবার রোগলক্ষণ প্রকাশ পেলে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। রোগটির লক্ষণ প্রকাশের প্রথমদিকে কেবল ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা থাকে। প্রাথমিকভাবে এ অনিদ্রা থাকে মৃদু প্রকৃতির। কিন্তু যতই দিন যায় এ অনিদ্রাজনিত সমস্যা আর কমে না বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা থেকে শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য পর্যন্ত হতে পারে।
এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে একে একে ভর করে হ্যালুসিনেশন, অর্ধচৈতন্য, ওজন হ্রাস, দৃষ্টিক্ষমতা, যৌনক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি লোপ এবং অবশেষে মৃত্যু। শেষের দিনগুলোতে রোগী হাঁটতে বা কথা বলতে বা খাবার গিলতে পর্যন্ত পারে না এবং অনেক সময় কোমা পর্যায়েও চলে যায়। নিদ্রা ছাড়াও এ রোগে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলশ্রুতিতে শরীরের তাপমাত্রা, ঘাম, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের হার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে ১৮-৬০ বছরের মধ্যে যেকোনো সময়। তবে সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পরেই বেশিরভাগ রোগীর উপসর্গ দেখা যায়। উপসর্গ প্রকাশের কয়েক মাস থেকে বছর দেড়েকের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে।
সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো- এ রোগের এখনো কোনো সঠিক প্রতিকার আবিষ্কৃত হয়নি। এমনকি বিভিন্ন ঘুমের ওষুধ অথবা বারবিচুরেট জাতীয় ওষুধে রোগের আরও অবনতি ঘটতে দেখা গেছে। কয়েকটি দেশে এটি নিয়ে এখনো চলছে নিরন্তর গবেষণা। এককথায় বলা যায়, ‘যখন ঘুম আসে না, তখন মৃত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়ে’। বাক্যটি ফ্যাটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসোমনিয়ার ভয়াবহ রূপকেই প্রকাশ করে।
এসইউ/এএ/জেআইএম