পরকীয়া: নিষিদ্ধ সম্পর্কের ঘেরাটোপ
মেহেরুন্নেছা
জীবনব্যাপী মানবের যত আয়োজন, সে কেবল সুখের জন্যই। সুখের জন্যই দু’জন মানুষ বিয়ের পিঁড়িতে বসে। নীড় রচনা করে। সংসার শুরু করে। সন্তানাদি হয়। অনেকেই সুখ-দুঃখ মিলিয়ে একে অপরের হাত ধরে জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্ত কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই কারো সুখের সংসারে কালো মেঘ জমে। দুজনের সম্পর্কে প্রবেশ করে তৃতীয় আরেকজন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের দুর্বলতার কোনো এক ফাঁকে এই অবাঞ্ছিত সম্পর্কের বীজ বপিত হয়। এটি সমাজ কর্তৃক ঘৃণ্য একটি মর্যাদাহীন সম্পর্ক। মানব-মানবীর এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের নামই হলো ‘পরকীয়া’। ‘পরকীয়া’ অনগ্রসর সমাজ কর্তৃক আরোপিত একটি নেতিবাচক শব্দ।
পরকীয়ার বিপক্ষে কথা বললে তথাকথিত নৈতিকতার খোলসে আবদ্ধ সমাজ আমোদে ফেটে পড়ে। বিশেষ করে রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ, গোঁড়া, কূপমণ্ডুক একটি শ্রেণি ব্যাপারটা চরমভাবে লুফে নেয়। তারা মনে করে, যে পরকীয়ায় লিপ্ত সে পাপিষ্ঠ। সে সমাজ বহির্ভুত ও ধর্ম বহির্ভুত কাজ করছে। তাদের দৃষ্টিতে পরকীয়ায় লিপ্ত নারী-পুরুষ সবাই ঘৃণ্য। সভ্যতার ক্রমবিকাশের এই পর্যায়ে এসেও আমাদের সমাজ বিবাহ-বহির্ভুত সম্পর্কের ব্যাপারে ধর্ম ও সামাজিক ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেনি। এই সম্পর্ক সমাজ কর্তৃক এখনো স্বীকৃত নয়। এখানে পরকীয়া একটি অনাকাঙ্ক্ষিত-অবাঞ্ছিত সম্পর্ক।
আবার পরকীয়ার পক্ষে কথা বললে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমাজ টানা-হেঁচড়া শুরু করে। মানুষটিকে চরিত্রহীনসহ আরও কদর্য বাক্যবাণে অপদস্থ করে। আর তিনি যদি হন একজন লেখক তাহলে তো আক্রমণের তোড় আরও বেগবান হয়। অথচ একজন লেখক সবসময় সামাজিক গভীর মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের মাধ্যমে কঠিন সত্যকে উন্মোচন করেন। তিনি কখনো সমাজ ও মানুষকে নিয়ে সাধারণের ন্যায় দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন না। তিনি গোপন স্বভাব গোপন রেখে লোক দেখানো ন্যায়, সত্য ও ধর্মের বুলি আওড়ে নিজেকে সাধু জাহির করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন না। প্রকৃত লেখক এসব দোষে দুষ্ট নন। তার কলমের বলিষ্ঠ লেখনিতে তিনি সমাজকে খুঁড়ে মানব চরিত্রের সত্যটাকে তুলে আনেন। তিনি মানব-মানবীর সম্পর্ককে উদারতা, মানবিকতা, সংবেদনশীলতা ও যৌক্তিকতার নিরিখে দেখতে ভালোবাসেন।
অথচ এই সমাজে ‘পরকীয়া’ শব্দটির পুরোটা জুড়েই অপবাদ ও নেতিবাচকতার নিনাদ ফুটে ওঠে। এই শব্দ দ্বারা সমাজ গোপন প্রেম ও ভালোবাসাকে ছিন্নমূলের ন্যায় উপড়ে ফেলতে চায়। এই শব্দ দ্বারা সমাজ অনাহূত সম্পর্কের সত্যটাকে নিমেষে নিক্ষেপ করে আস্তাকুঁড়ে। তারপরও এই সম্পর্কের মাঝে থাকে শাশ্বত একটি ভালোবাসার গল্প। এই প্রেম যতই গোপন হোক না কেন, তা মানব-মানবীর জৈবিক সম্পর্কের বলিষ্ঠতার ইঙ্গিতবহ। মানব-মানবীর একের প্রতি অন্যের গভীর টান। কারো কারো হৃদয়ের গহীন নকশার সাথে হয়তোবা কারো কারো নকশা অসময়ে মিলে যায়। ধীরে ধীরে মানব-মানবী গোপনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এ সম্পর্কের জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সত্যটা আসলে কোথায়?
হয়তো আটপৌরে দীর্ঘ বিবাহিত জীবন কারো কারো কাছে ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে হয়ে উঠতে পারে। দাম্পত্য সম্পর্কে অতৃপ্তি আসতে পারে। রোগ-ব্যাধি-রুচি-শিক্ষা-আর্থিক দৈন্যসহ বিভিন্ন কারণে শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। কোনো কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক কলহের বেড়াজালে আটকে যেতে পারে। এ ছাড়াও বাহ্যিকভাবে আপাত সুখে নিমজ্জিত মনে হলেও অন্তরালে কেউ কেউ শারীরিক ও মানসিকভাবে তৃষ্ণা অনুভব করতে পারে। মানব মন বড় বিচিত্র। গোপন চাওয়ার পরিধি এবং তার ধাবমানতা কখন যে কার দিকে এগিয়ে যায়, সেটা হয়তো সে ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারে না। হয়তো তার চারপাশে জলে টইটুম্বুর; তারপরও তিনি থাকেন তৃষ্ণার্ত। ফলশ্রুতিতে জড়িয়ে পড়েন স্বতঃস্ফূর্ত নিষিদ্ধ ভালোবাসায়। যে ভালোবাসায় কালিমা আরোপ করে সমাজ; ট্যাগ লাগিয়ে দেয় পরকীয়ার।
অন্যদিকে বিয়ে একটি ধর্মীয় ও সামাজিক চুক্তি। বিয়ের পর প্রত্যেক মানুষের দাম্পত্য জীবনের নকশা হতে পারে শিল্পের ন্যায়, যা একমাত্র ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকলেই সম্ভব। বিয়ের মাধ্যমেই নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ধর্ম ও সামাজিকতার বৈধতায় আবদ্ধ রাখে সমাজ। তবে অপছন্দের মানুষের সাথে থাকা নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক। তাই কোনো কোনো অতৃপ্ত ও অসুখী মানুষের কাছে পরিস্থিতির জটিলতায় বৈবাহিক সম্পর্ক একটা খাঁচায় বন্দি জীবন হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ধর্ম ও সমাজ যতই অসুখী বৈবাহিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করুক না কেন, তাতে ব্যর্থ হয়। সময়ের ফলশ্রুতিতে মানুষ তার জৈবিক প্রয়োজনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙে জীবনকে উপলব্ধির অন্যমাত্রায় নিতে অনেক বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে সময়ের সাথে সাথে মানুষ তার জীবন যাপনের অভিরুচির রূপান্তর ঘটায়। মানবের এ জীবন যেন স্রোতে ভেসে চলা এক কাব্য-গাঁথা। সেই স্রোতে ভেসে থাকার জন্য মানব তার ভালোলাগার মানুষকেই একান্তে কাছে রাখার আকুতি অনুভব করে। এটাই মানবের জৈবিক নিয়তি। কিন্তু সবার ভাগ্যে ভালোবাসাময় সংসার গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ভালোবাসাহীনতায় থেকে মানব তার নশ্বর জীবনকে সমাজ ও ধর্মের ভয়ে টেনে-হেঁচড়ে অনেকটুকু পথ নিতে পারে হয়তো; তবে সেটাকে বেঁচে থাকা বলে না। তাই মানব যেখানে ভালোবাসার মর্মর ধ্বনি শুনতে পায় সেদিকেই ধেয়ে যায়। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে-নীরবে-নিভৃতে সে সেই মানুষের কাছেই নিরন্তর ছুটে চলে। কারণ ভালোবাসাই জীবন। ভালোবাসা অন্ধ। ভালোবাসা এক স্বর্গীয় দীপ্তি।
এই গোপন ভালোবাসার শক্তিও কিন্তু অপরিমেয়। নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ ভালোবাসায় বুঁদ ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত অভিলাষের জয়যাত্রা দেখাটাকেই সেই সময়ের ব্রত ধরে নেয়। সে তার ভালোবাসার খাতিরে সব সামাজিক নীচতা ও কূপমণ্ডুকতাকে অগ্রাহ্য করে নিজের আত্মার চাওয়াকে প্রাধান্য দেয়। ফলে সে নিপতিত হয় সামাজিক বিশৃঙ্খলায়। আমাদের সমাজ একদিকে যেমন শক্তিশালী, আরেকদিকে প্রচণ্ড নীপিড়ক। সমাজকে পাত্তা না দেওয়ার জন্য তাকে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ও অপমানের মুখোমুখি হতে হয়। তাই পরকীয়া কিংবা নিষিদ্ধ পথে হাঁটা কোনো সমাধান নয়। বরং মানব-মানবী ধর্ম ও সামাজিকতার মধ্যে থেকেই জীবন পরিচালনা করা উচিত। এখন পর্যন্ত সামাজিকতার মধ্যে থেকেই ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী করাটা জীবনকে সুখকর ও ভারমুক্ত করার সবচেয়ে ভালো উপায়। অন্যথা নিষিদ্ধ সম্পর্ক যাপিত জীবনকে করে তোলে গ্লানিময়।
মানব-মানবীকে অস্থির-হিংস্র-ঘৃণ্য দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে সামাজিকতার মধ্যেই সম্পর্কের প্লাটফর্ম বুনতে হবে। জীবনের সকল হীনতা ছাপিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সংযমের আঙিনায় বিচরণেই সুখ নিহিত। বিয়ের মাধ্যমেই সমাজে মর্যাদার সাথে ভালোবাসাময় আবহে জীবনকে নিমগ্ন করা যায়। কোনো অবস্থাতেই পরকীয়া নয়। পরকীয়া জীবনে সামাজিক বৈকল্য নিয়ে আসে। পরকীয়া জীবনকে অস্থির করে তোলে। পরকীয়া জীবনকে মর্যাদাহীনতার নরকে নিক্ষেপ করে। সর্বোপরি পরকীয়া আপাত সুখ দিলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হলো জীবনভর দুঃখকে কিনে নেওয়া।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।
এসইউ/এএ/জেআইএম