ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

আইসোলেশনে থাকা রোগীরা যা করবেন

ডা. হিমেল ঘোষ | প্রকাশিত: ১২:৩৬ পিএম, ১৮ মে ২০২০

বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এ রোগের প্রতিষেধক না থাকায় বাড়ছে আশঙ্কাও। তবে করোনা সংক্রমিত হলেই যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। করোনা আক্রান্তদের শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ, যাদের কোনো উপসর্গ নেই অথবা মৃদু উপসর্গ আছে। তারা বাসায় আইসোলেশনে থেকে, সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে, বিশ্রাম নিয়ে এবং চিকিৎসকের নিদের্শনা অনুযায়ী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারেন। শতকরা ১০-১৫ ভাগ রোগীর শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তির দরকার হয়। এমনকি শতকরা ৫-৬ ভাগ রোগীর আইসিইউ দরকার হতে পারে।

যারা আইসোলেশনে থাকতে পারেন—
১. কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কারো সংস্পর্শে না এসে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িক সাহায্যের জন্য পরিবারের একজন সদস্য, যিনি সুস্থ, যার ক্রোনিক কোনো রোগ নেই, এমন একজন সংক্রমিত ব্যক্তির পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

২. যদি আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কোনো রোগের উপসর্গ না থাকে অথবা প্রাথমিক মৃদু উপসর্গ, যেমন- জ্বর, সর্দি, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা থাকে। তাহলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাসায়ই চিকিৎসা নিতে পারেন।

৩. যদি আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো ক্রোনিক রোগ, যেমন- হাঁপানি, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিয়েকটেসিস, কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের রোগ ইত্যাদি না থাকে।

আইসোলেশন যাদের জন্য প্রযোজ্য নয়—
১. কোভিড-১৯ আক্রান্ত বৃদ্ধ রোগী। তাদের বাসায় না রেখে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নিতে হবে।

২. আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের জটিল শারীরিক লক্ষণ, যেমন- শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভব করা, তীব্র কাশি ও নিউমোনিয়া রয়েছে কিংবা যাদের তীব্র ডায়রিয়া অথবা বমির উপসর্গ আছে এবং রক্তে ইলেক্ট্রলাইটের মাত্রা নিরূপণ এবং শরীরে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। তাদের বাসায় রাখা ঠিক হবে না।

৩. আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের দীর্ঘমেয়াদী রোগ জটিল পর্যায়ে আছে, যেমন- হাঁপানি, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিয়েকটেসিস, হৃদযন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা কিডনি, লিভার, ক্যান্সারের রোগী। তাদেরও বাসায় রাখা যাবে না।

আইসোলেশনে যা করবেন—
১. যে ঘরে জানালা আছে এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে, আক্রান্ত ব্যক্তি বাড়ির এমন একটি ঘরে আইসোলেটেড থাকবেন। ঘরটিতে কার্পেট এবং বাড়তি আসবাবপত্র থাকলে সেগুলো সরিয়ে ঘরটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে দিতে হবে। ঘর সংলগ্ন টয়লেট থাকা বিশেষ জরুরি।

২. ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতে হবে। পরিচর্যাকারী ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন কখনো সেই ঘরে প্রবেশ না করে অথবা আক্রান্তকে বাইরে থেকে দেখতে যেন কেউ না আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ঘরে প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন- মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, ওষুধপত্র, টিস্যু বক্স, গ্লাস—এগুলো রাখতে হবে, যেন প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায়।

৪. আক্রান্ত ব্যক্তি ঘরে বসেই যেন পানি গরম করে নিয়মিত গার্গল করতে পারেন। স্টিম ভ্যাপার নিতে পারেন। আদা, লেবু, টি-ব্যাগ দিয়ে চা তৈরি করে খেতে পারেন। এ জন্য ঘরে ইলেকট্রিক কেটলি দেওয়া ভালো।

৫. ঘরে আবর্জনা, ব্যবহৃত টিস্যু, মাস্ক, গ্লাভস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না রেখে মুখবন্ধ বিনে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রাখতে হবে। ব্যাগটি পূর্ণ হলে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে গ্লাভস পরে ব্যাগটির মুখ বন্ধ করে ব্যাগের বাইরে জীবণুনাশক ব্লিচিং সলিউশন ছিটিয়ে রেখে দেবেন। পরিচর্যাকারীকে হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক পরে ওই ব্যাগ সংগ্রহ করে মুখবন্ধ অবস্থায় মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

৬. দৈনিক পর্যাপ্ত পানি পান করা প্রয়োজন। বিধায় ঘরেই বড় কনটেইনারে পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. কিছু প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সরঞ্জাম, যেমন-থার্মোমিটার, ডিজিটাল রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র, সম্ভব হলে পালস অক্সিমিটার, ডায়াবেটিস থাকলে স্ট্রিপসহ গ্লুকোমিটার (হঠাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া থেকে রক্ষার জন্য সতর্কতা হিসাবে গ্লুকোজ অথবা চিনি) দেওয়া আবশ্যক।

৮. ঘরের টেবিল, ব্যবহৃত স্পর্শকাতর জিনিসপত্র, মোবাইল, ল্যাপটপ, দরজার নব অথবা হ্যান্ডেল, লাইটের সুইচ শতকরা ৭০ ভাগ অ্যালকোহল আছে এমন সলিউশন দিয়ে প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।

৯. আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্ভব হলে নিজে অথবা পরিচর্যাকারীর সাহায্য নিয়ে প্রতিদিন জীবাণুনাশক ব্লিচিং পাউডার পানিতে মিশিয়ে গ্লাভস পরে ঘরের মেঝে, বাথরুম পরিষ্কার করতে হবে।

১০. প্রতিদিন গোসলের সময় পরিহিত কাপড়, তোয়ালে এবং সপ্তাহে দুইবার বিছানার চাদর, বালিশের কাভার গরম পানি, সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে।

১১. প্রতি বেলার খাবার দেওয়ার সময় পরিচর্যাকারী গ্লাভস, মাস্ক পরে ননটাচ প্রক্রিয়ায় খাবার দেবেন। খাবারের সময় ব্যবহৃত গ্লাস, প্লেট, কাপ রোগী নিজেই গরম পানি, সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখবেন।

১২. প্রোটিনসমৃদ্ধ, হালকা মসলাযুক্ত, সহজপাচ্য, পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে এবং তৈলাক্ত খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি গরম পানি ফুটিয়ে লবণ দিয়ে দিনে কয়েকবার গার্গল করতে হবে। এ ছাড়াও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- লেবুর শরবত, মাল্টার জুস বেশি পান করতে হবে। লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ, আদা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে এ পানীয় গরম করে পান করলে গলা ব্যথা, শুকনো কাশির অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রোগীর কোনো উপসর্গ না থাকলে ভিটামিন ‘সি’ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।

১৩. প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকের জ্বর, সর্দি ও কাশির সমস্যা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্যারাসিটামল, ফেক্সোফেনাডিন, ক্লোরফেনিরামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ ট্যাবলেট খেতে হবে। প্রথম সপ্তাহে ডায়রিয়া ও বমি দেখা দিতে পারে। এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, জিংক ট্যাবলেট খেতে হবে।

১৪. আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় সাত দিনের পরও জ্বর না সারলে, কাশির তীব্রতা বেড়ে গেলে, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা বা শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ অনুভব করলে বা হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

এ ছাড়াও কোডিভ-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি দিনে কয়েকবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন এবং হাঁচি ও কাশির শিষ্টাচার মেনে চলবেন। এ সময়ে উদ্বিগ্ন থাকা স্বাভাবিক, তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। পাশাপাশি দিনে কয়েকবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে হবে। ঘরের মধ্যেই হাঁটা, যোগাসন অথবা হালকা ব্যায়াম করা উচিত। ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করলে এ সময়ে দুশ্চিন্তা কম হবে। পাশাপাশি গল্পের বই পড়া, পছন্দসই গান শোনা যেতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম এ সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। একাকিত্ব কাটানোর জন্য এবং মানসিকভাবে নিজেকে চাঙা রাখার জন্য অবসরে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেই মৃত্যু বিভীষিকা, আইসিইউ বা ভেন্টিলেটরের আতঙ্ক নয়। সব নেতিবাচক ভাবনা ছেড়ে সাহস আর ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা আর দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে করোনা মহামারীকে মোকাবেলা করা উচিত।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন