অনলাইনে ক্লাস নিয়ে যা ভাবছেন শিক্ষার্থীরা
‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকতে পারে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- এমন ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কী ভাবছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? এ নিয়ে ছয় শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরছেন রেদওয়ানুল ইসলাম-
জারিন তাসনিম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা ভাইরাসের ব্যাপকতা আটকাতে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনিশ্চয়তায় ঝুঁকছে শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাসহ আটকে আছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম। এদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ হতে পারে করোনার রূপ। অসুস্থ পৃথিবীতে কবে আসবে সুস্থতা-তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় অনলাইন ক্লাস কতটা যৌক্তিক? শিক্ষা কার্যক্রমের স্থবিরতা কাটাতে অনলাইন ক্লাস সহায়ক হতে পারে। পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলেও এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে শিক্ষাদান কর্মসূচি। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে সেশনজট কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা আছে কি-না তা ভাবতে হবে। ৪জি যুগে বাংলাদেশে এখনো কিছু গ্রাম আছে যেখানে নেটওয়ার্ক সংযোগ যথেষ্ট না। ‘Out of service area’, ‘Mobile network is not available’ অবস্থার নেটওয়ার্কে থাকা গ্রামে ২জি, ৩জি তো পূর্ণিমার চাঁদ, ৪জি কল্পনাতীত। এমতাবস্থায় এসব এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হবে। ফলে মনে করি, বিষয়টি আরও ভেবে দেখা উচিত।
আসিফ হাসান রাজু, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহ অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা একটি যুগান্তরকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারলে বিশ্বায়নের এ যুগে টিকে থাকা মুশকিল। তবে বর্তমান দেশের প্রযুক্তিব্যবস্থা বিবেচনায় আনলে অনলাইনে ক্লাস বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা, এর জন্য যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন, সেটি হয়তো সব শিক্ষার্থীর নেই। বিশেষ করে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে, তার বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের। দেশে এখনও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে, যেখানে নেটওয়ার্কের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। তাদের কাছে অনলাইনে ক্লাস যেন বিলাসিতার সামিল। কেননা অনলাইনে ক্লাস করতে হলে উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট, ভালো স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটর ও তাদের নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবার মানও উন্নত বিশ্বের মত ভালো নয়। এ ছাড়া এ মহামারীতে এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে শ্রমজীবীসহ যারা টিউশনি, পার্টটাইম জব করে পরিবার ও নিজেদের খরচ বহন করত। তাদের কাছে এ মুহূর্তে অনলাইনে ক্লাস একেবারে বেমানান। তবে সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি উদ্যোগ নেয় অনলাইনে ক্লাস ফ্রি করে দেওয়ার, তাহলে হয়তো অনেকে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
তন্বী আক্তার, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ আছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ইউজিসি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হবে। যেটি অনেক ভালো একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন রাজধানীর বাইরে নিজ গ্রামে অবস্থান করছেন। ফলে অনেকেই ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা উচ্চমূল্যের কারণে ক্লাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না বলে মনে করি। কারণ এমন অনেক প্রত্যন্ত এলাকা রয়েছে যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না, সেখানে অনলাইন ক্লাস কল্পনাতীত ব্যাপার। এ ছাড়া বর্তমানে একটি পরিচিত চিত্র যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, তা হলো অনেক পরিবারে দেখা দিচ্ছে আর্থিক অস্বচ্ছ্লতা ও মৌলিক চাহিদার সংকট। এমতাবস্থায় যদি অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয় তা অনেকের জন্য অসম্ভব। যদি প্রযুক্তির ব্যবহার সব জায়গায় সফলভাবে পরিচালিত হতো। তাহলে এমন উদ্যোগ কার্যকরী হতে পারত। অনলাইন ক্লাস করার অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে সেশনজটকে। বর্তমানে সেশনজট অনেক কমিয়ে আনা হলেও করোনার প্রভাবে আবারও সেশনজটের আশঙ্কা রয়েছে। তবে শুধু অনলাইনে কম-বেশি ক্লাস নিলেও এত দ্রুত এ সংকটের সমাধান হবে না। এর জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষা ক্যালেন্ডার সমন্বয় করে বেশি বেশি ক্লাস ও বেশি সময় নিয়ে ক্লাস করে এ সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব বলে মনে করি। এ ছাড়া শিক্ষা যেহেতু সার্বজনীন, তাই সবার সুবিধা ও অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সাদিয়া সাবাহ্, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান সংকটকালীন আমরা অনেক রকম সমস্যার মুখোমুখি। করোনা সংকটে পুরো বিশ্ব যেখানে থমকে গেছে; সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও স্থবির। অনেকেই ঘরে বসে থাকতে থাকতে একঘেয়ে এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, তেমনি অনেকেই নিত্যদিনের খাদ্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এমন অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস কতটা যৌক্তিক সেটিই বড় প্রশ্ন। অনেকেই হয়তো বলবে ক্লাসটা যৌক্তিক। বাস্তবতার দিক দিয়ে দেখলে, একদিন পৃথিবী সুস্থ হবে, আমাদের এ চিন্তা করেই ক্লাস অব্যাহত রাখা উচিত। কিন্তু এ বিষয়ে আমি চরম অনীহা প্রকাশ করছি। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যদি আমাদের দেশেও অনলাইনে ক্লাস চালু হয়, তাহলে আমরা নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হবো। যেমন- আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। যারা ইতোমধ্যে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে গেছে। যাদের বাড়ির কর্তা কৃষক, তারা শাক-সবজি বা ফসল বিক্রি না করায় আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে। এমনকি আমাদের দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীর বাবা মজুর, শ্রমিক- যারা এখনো বেকার। যেসব শিক্ষার্থী নিজেই টিউশনি এবং নানা রকম পার্ট টাইম চাকরির মাধ্যমে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো। এ মুহূর্তে অনলাইনে ক্লাসকে আমি শুধুমাত্র মানসিক চাপ বলে মনে করছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই স্মার্ট ফোন অথবা ল্যাপটপ নেই। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করার যে খরচটা লাগবে সেটাই বা কোথা থেকে! আর গ্রামে নেটওয়ার্ক সার্ভিসের কথা না-ই বা বললাম। ২জি নেটওয়ার্ক দিয়ে আর যা হোক, অনলাইনে ক্লাস করা যায় না। যদি অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, শুধু রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে যেসব শিক্ষার্থীর বাসা, তারা হয়তো ক্লাস করতে পারবে। আর বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা গ্রামে বসবাস করে তারা বঞ্চিত হবে। তাই আমার কাছে এ সময় অনলাইনে ক্লাস করানোর সিদ্ধান্তটা নিতান্তই বিলাসিতা।
রাকিবুল হাসান রাকিব, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বায়নের এ যুগে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে যে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। কেননা উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশের প্রযুক্তি খাতে এখনো সেই মানের উন্নয়ন ঘটেনি। চড়া মূল্যের ইন্টারনেটের পাশাপাশি দুর্বল গতি তো রয়েছে, সেই সাথে এমন অনেক অঞ্চল আছে; যেখানে কথা বলার মত ভালো মোবাইল নেটওয়ার্কের সুযোগ নেই। যদি কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে অটুট থাকে, তাহলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীর দিক বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় একটি অংশ উপকৃত হবে আর বৃহৎ অংশ হয়তো অংশ নিতে পারবে না। একটি বিষয় মানতে হবে, আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছি, তাদের একটি বৃহদাংশ গ্রামঞ্চল থেকে আসা। ফলে যেখানে কথা বলার নেটওয়ার্ক পাওয়া দুস্কর, সেখানে অনলাইনে ক্লাস করাটা অসম্ভব। এমন পরিস্থিতে এ উদ্যোগ আশার মুখ দেখবে বলে মনে করি না। আর যদি কার্যকর হয়, তাহলে একটি বৃহদাংশ বঞ্চিত হবে বলে মনে করি।
সালমান শাকিল, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মহামারী ও লকডাউনের মধ্যে শিখনের নয়াপদ্ধতি অনলাইনে ক্লাস। ডিজিটাল এ উদ্যোগ যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের একরকম ডিটাচড্ হয়ে যাওয়া লেখাপড়ায় কিছুটা হলেও সংযোগ ঘটবে। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের বর্তমান রুদ্ধতা কেটে যেতে পারে। তবে যাদের জন্য এ আয়োজন, সে আয়োজনে সবার অংশগ্রহণের সামর্থ রাখে কি-না সে দিকেও বিবেচনায় রাখা দরকার বলে মনে করি। কারণ আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভাই-বোন আছেন, যাদের প্রযুক্তি সামর্থ নেই। অধিকাংশই গ্রামে যাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া নিয়েই অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হওয়াটা একরকম কষ্টসাধ্য। তাই সামর্থের উপর দৃষ্টি রেখে বেশিরভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে যাতে অনলাইন ক্লাসের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায়, সেই দিকটা বিবেচনায় রাখতে বলবো।
এসইউ/জেআইএম