করোনাভাইরাস কি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে?
ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব
পরিবর্তন কি সব সময় ভীতিকর? স্বভাবগতভাবে আমরা যেকোন পরিবর্তনের কথা শুনলে প্রথমেই ভড়কে যাই। কিন্তু পরিবর্তন প্রায়শই ভালো কিছুরও জন্ম দেয়। আমরা যখন কোন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করি, তখন তার কিছু পরিবর্তন আমাদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। কল্পনা করুন, একজন সন্ত্রাসী অনেক মানুষকে হতাহত করছে তার হাতের বন্দুকের গুলিতে। যদি তাকে আমরা প্রতিঘাত করতে পারি এবং সেই আঘাতটি যদি তার মাথায়, হাতে বা পায়ে লাগে তাহলে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে কমবে।
আমাদের শরীরে যখন কোন জীবাণু প্রবেশ করে তখন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে জড়িত উপাদানগুলো সেই জীবাণুটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। জীবাণুর বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আমরা জিতে যাই। আপনি কল্পনা করুন বছরে কতদিন আপনি সুস্থ থাকেন, আর কতদিন অসুস্থ থাকেন? শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি জিততে না পারতো, তাহলে আমরা একবছরের মধ্যে বহুবার মারা যেতাম। কিন্তু সেটা ঘটছে না। কারণ, জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা জিতে যাচ্ছে। কখনো কখনো এই ব্যবস্থাকে সাহায্য করার জন্য আমরা ওষুধ-পথ্য খাই। যা আমাদের জয়কে তরান্বিত করে।
বর্তমানে নতুন করোনাভাইরাসের ভেতর শত শত পরিবর্তন হয়েছে বলে সর্বত্র আলোচনা এবং বেশিরভাগ সময়ই এমনভাবে বিষয়টা তুলে ধরা হচ্ছে যে, এই পরিবর্তন বুঝি ভাইরাসটিকে ‘সুপারবাগ’ বানিয়ে ফেলছে। আরো ধ্বংসাত্মক করে তুলছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, নতুন করোনাভাইরাসের বেশিরভাগ পরিবতর্নকেই বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে নিউট্রাল ড্রিফট (neutral drift)। এর অর্থ এই পরিবর্তনগুলোর ফলে ভাইরাসের কার্যক্ষমতায় কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে না।
দ্বিতীয়ত যেসব পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকবে, তাদের সবগুলোই ভাইরাসের জন্য উপকারী হবে, তাকে মহাশক্তিশালী করে তুলবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। পরিবর্তনটি কোথায় হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। ইতোমধ্যেই গবেষণাগারে একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভাইরাসে একটি বিশেষ অবস্থানে পরিবর্তন এর সংক্রমণ ক্ষমতা ২৭০ গুণ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
করোনাভাইরাসের জিনোম তথ্যে তিন শতাধিক পরিবর্তন পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এদের মধ্যে ধারাবাহিক তিনটি অবস্থানে পরিবর্তন হয়েছে এমন ভাইরাস পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে কম মানুষ আক্রান্ত হয়েছে সেখানে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। একটি গবেষণাপত্রে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
ভাইরাস যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তাকে কিন্তু নানাভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। সেই প্রতিরোধের কিছু আঘাত তাকে দুর্বল করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। সুতরাং নতুন করোনাভাইরাস কারো না কারো শরীরে গিয়ে আঘাত পাবেই এবং দুর্বল হবেই। যদিও তার ফলাফল দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সেই অপেক্ষার কালটা কতটুকু হবে বিজ্ঞানীরা তা নিয়ে গবেষণা করছেন।
আমাদের আশাবাদী হওয়া দরকার। এই ভাইরাস অনন্তকালের জন্য আসেনি। অনন্তকাল থাকবেও না। সঠিক পরিকল্পনা নিতে পারলে আরও অনেক সফলভাবে এর মোকাবেলা করা যেত। এখনো যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ সেটা করে দেখিয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই সফল ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করছে। অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এই যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তথ্য-উপাত্ত জেনে আমরা সতর্ক হতে পারছি, ব্যবস্থা নিতে পারছি এটাও কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই অবদান। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী কী ব্যবস্থা নিতে পারি, সেটা সাবান ব্যবহার হোক কিংবা মাস্ক ব্যবহার- সবকিছুর ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা যথসম্ভব দ্রুততার সাথে তথ্য দিয়েছেন। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে এসব তথ্য আমরা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় তাড়াতাড়ি হাতে পেয়েছি।
শুধু একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে- প্রযুক্তি ভালো তথ্য যেমন সবার কাছে পৌঁছে দেয়, তেমনি ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়িয়ে পড়তে পারে। একটি ভুল তথ্য আমাদের আতঙ্কিত করে তুলতে পারে। তাই যেকোন তথ্য বিশ্বাস করার আগে, শেয়ার করার আগে একটু দেখে নিতে হবে, একাধিক উৎস থেকে একটু যাচাই করলেই আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধাটুকু ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবো।
নতুন করোনভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছে, আমরা আশাবাদী একটা সমাধান আমরা পাবো। অতীতের তুলনায় দ্রুততর সময়েই পাবো। তার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে দেশের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে- এ ব্যাপারে সর্বোচ্চরকম চেষ্টা করতে হবে।
শেষ কথা হচ্ছে, পরিবর্তন শুনে আমরা যেন ভয় না পেয়ে যাই। পরিবর্তন হোক- ভাইরাসেরও হোক। কিছু পরিবর্তন তাকে দুর্বল করবে। আমরা অপেক্ষায় থাকি। আশাবাদী হই। আঁধার কাটবেই। কারণ, কোন দুযোর্গই চিরস্থায়ী নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/পিআর