করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন
সাইফুল ইসলাম তালুকদার রনি
ক্ষুদ্র এক ভাইরাস আমাদের পৃথিবীর গতি হঠাৎ এভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তা ছিল কল্পনার বাইরে। পৃথিবীতে দেখা দেওয়া মহামারী ‘করোনা’ শুধু স্বাস্থ্য নিয়েই ভাবাচ্ছে না, ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের জীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে। পরিবর্তন করে দিয়েছে জীবনযাত্রার পথ। পৃথিবীর আগামী কর্মপরিকল্পনা, ধ্যান-ধারণা বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং যোগাযোগের ধরন।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষের সম্পর্কগুলো অফলাইন থেকে অনলাইন হতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে যখনই কোন মহামারী তৈরি হয়েছে, তখন নতুন চ্যালেঞ্জসহ নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে সচল পৃথিবীতে হঠাৎ আসা মহামারীর স্থবিরতা প্রযুক্তির দ্বারা সচল রাখতে হয়, কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈশ্বিক মহামারীর ক্ষয়-ক্ষতি কমানো যায়।
সেই পুরোনো ধ্যান-ধারণার শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয় এখন আর নেই। এখন ঘরে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারেই হয়ে যাচ্ছে একটি ক্লাসরুম, এক সাথে অনেকগুলো ক্লাসরুম নিয়ে তৈরি করা যায় অনলাইন বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরাও যে ক্লাসে ভালো লাগে সেই ক্লাসেও প্রবেশ করতে পারে খুব সহজে। একটি মোবাইল বা কম্পিউটারের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনেক এডুকেশনাল ওয়েবসাইট ব্যবহার করে আপনি তৈরি করতে পারেন অনলাইন বিদ্যালয়। জুম তেমনই একটি চমৎকার ওয়েবসাইট। জুম ওয়েবসাইট বিনা মূল্যে ব্যবহার করে একজন শিক্ষক একসাথে ১০০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতে পারেন। উত্তর আমেরিকায় জুমের মাধ্যমেই চলছে ক্লাস।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি ডিজিটাল এডুকেশন গড়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সময় এখনই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সমন্বয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা সম্পূর্ণ ডিজিটাল করতে পারলেই করোনা মহামারীর এই বৈশ্বিক সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে তোলা সম্ভব।
তাহলে কিভাবে এ ডিজিটাল এডুকেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যায়, তার কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
টিচিং-লার্নি এনভায়রনমেন্ট: ডিজিটাল এডুকেশন ব্যবস্থা চালু করার জন্য সর্বপ্রথমে আসে শিক্ষা পরিবেশ বা টিচি-লার্নিং এনভায়রনমেন্ট প্রস্তুত করা। এ মুহূর্তে সবাই বাড়িতে অবস্থান করছেন। নিজের চারপাশে যা আছে, সেখানে বসে এ টিচিং-লার্নি পরিবেশ গঠন করতে পারেন। একজন শিক্ষক একটি কক্ষে কিংবা খাবারের টেবিলে বসেও চালাতে পারেন এ কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়ার কক্ষে বা খাবার টেবিলে বসে অনলাইন এডুকেশন প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারে। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে পারেন। যেন বাসায় বসে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে এ পড়াশোনা করতে পারে। অভিভাবকরা চেষ্টা করবেন, বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ ঠিক আছে কি-না বা মোবাইলে ডাটা আছে কি-না তা খেয়াল রাখতে। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক মনোবলও সুদৃঢ় করাটা লার্নিং এনভায়রনমেন্টের অংশ।
টিচিং টুলস: লার্নিং এনভায়রনমেন্ট নিশ্চিত হলে এখন আসি টিচিং টুলস নিয়ে। মোবাইল, কম্পিউটার থাকলেই শিক্ষার্থীদের আর বেশি কিছুর প্রয়োজন হবে না। কারণ আপনি অনলাইনেই অসংখ্য টিচিং টুলস পাবেন। অনলাইনে হোয়াইট বোর্ডও পাওয়া যায়। যা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সরাসরি লিখেও দিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইগুলো এনসিটিবির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। শুধু পাঠ্যক্রমই নয় বরং কারিকুলাম, শিক্ষক সহায়ক ও শিক্ষক সংস্করণগুলো পাওয়া যাবে www.nctb.gov.org ওয়েবসাইটে। তাছাড়া আরও যুগোপযোগী ও বিভিন্ন চমৎকার টিচিং টুলস আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন, টেনমিনিট স্কুল, ব্র্যাক এডুকেশন প্রোগ্রাম এবং সরকারে এটুএই প্রোগ্রামে পাবেন। টিচিং টুলস নিয়ে নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিনিয়ত ফেসবুকে একটু খোঁজ রাখলেই এডুকেশনাল অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।
অনলাইন ক্লাসরুম: এবার আমরা তৈরি করবো অনলাইন ক্লাসরুম। বর্তমানে টিচিং-লার্নি প্রক্রিয়াটি একটি যৌথ কার্যক্রম। কারণ শুধু শিক্ষক পড়াবেন আর শিক্ষার্থীরা শুনবেন- এমন দিন আর নেই। শিক্ষকরা এখন চাইলেই যেকোন তথ্য শেয়ার করা, আদান- প্রদান করা এবং শিক্ষার্থীদের মতামত সরাসরি জানতে পারেন।
শিক্ষকরা অনলাইনে যেসব ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারেন- জুম, ইউটিউভ লাইভ, ফেসবুক লাইভ, গুগল ক্লাসরুম এবং মাইক্রোসফট টিম। এ ওয়েবসাইটগুলোর সাহায্যে আপনি নিজের মত করে তৈরি করতে পারবেন আপনার ক্লাসরুম। খুব সহজে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতাও দিচ্ছে ওয়েবসাইটগুলো।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন: এবার আপনি শিক্ষার্থীদের অনলাইন পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করবেন কীভাবে। চাইলে সরাসরি প্রশ্ন করেও মূল্যায়ন করতে পারেন। গুগল ডক, গুগল ফর্ম ও ই-মেইলের গুগল ড্রাইভে শিক্ষার্থীদের বলুন প্রশ্নের উত্তরগুলো আপলোড করতে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা ছবি তুলে আপনাকে পাঠাতে পারেন ইমো কিংবা ম্যাসেঞ্জারে। মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একই পদ্ধতি ব্যবহার করে ভিডিও কলে ওয়ান টু ওয়ান বা গ্রুপে দিতে পারেন ফিডব্যাক।
গ্রুপ ওয়ার্কের সুযোগ: আমরা সাধারণত বিদ্যালয়ে Professional Learning Community (PLC) করতাম। আবার শিক্ষার্থীদের দলীয় কাজের বিষয়ে উৎসাহিত করতাম। হয়তো ভাবছেন, তাহলে অনলাইনে কি কাজগুলো করা যাবে না? অবশ্যই করা যাবে। শিক্ষার্থীদের আপনি গ্রুপ তৈরি করে দিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা চাইলে নিজেরা নিজেরা গ্রুপে কাজ করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস আপ এবং ইমোতে গ্রুপ তৈরি করলে। শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যেও এ গ্রুপের মাধ্যমে নানা সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
প্রশিক্ষণ: এ মুহূর্তে যে বিষয়টি অনেক প্রয়োজন, সেটি হলো- সময়ের সাথে তাল মেলানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। শিক্ষকরা চাইলেই বিনা মূল্যে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ইমার্জেন্সি-টিচিং-লার্নিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। পাশাপাশি সার্টিফিকেটও দিচ্ছেন। অনলাইন প্রশিক্ষণ এখন আর শুধু শিক্ষকদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। অভিভাবকরাও নিতে পারেন প্রশিক্ষণ। দেশে এ মুহূর্তে যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেয়, তাদের মধ্যে আলোকিত টিচার্স প্ল্যাটফর্ম, টেনমিনিটস স্কুল, লাইট অফ হোপ, খান একাডেমি অন্যতম।
অফলাইনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দেখতে পারেন সংসদ টেলিভিশন। অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকরা প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ক্লাস নেন এ টেলিভিশনের মাধ্যমে। অফলাইন ও অনলাইন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিক্ষকরা হয়ে উঠতে পারেন ‘ডিজিটাল এডুকেশনের’ অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক: এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অফিসার, আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন এবং সহযোগী শিক্ষা গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জেআইএম