করোনাভাইরাস কি পৃথিবীতে আগেও ছিল?
ফারাবী বিন জহির
করোনাভাইরাস এ মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম। ধনী থেকে গরিব রাষ্ট্র, উঁচু থেকে নিচু তলার মানুষ, বিন্দু থেকে সিন্ধু- এমন কোনো জায়গা নেই; যেখানে ভয়ঙ্কর রোগটি করাল থাবায় গ্রাস করেনি তাজা প্রাণ। স্মরণাতীত কালের সবচেয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে মানব জাতি। আরও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে- এ রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। বিষয়টি মানুষকে করে তুলেছে আরও অসহায়। এ চরম অসহায় অবস্থায় মানুষ পরম করুণাময়ের কাছে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম যে প্রশ্নটি মাথায় আসে, তাহলো রোগটি কি পৃথিবীতে এই প্রথম? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এ রকম দু’ ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরও বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’।
এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। ২১ শতকের আগ পর্যন্ত করোনাভাইরাসগুলো মানুষের দেহে সাধারণ সর্দি-কাশি ব্যতীত অন্য কোনো উপসর্গ বা রোগব্যাধি সৃষ্টি করত না। কিন্তু ২১ শতকে এসে এ পর্যন্ত ৩টি নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে (সার্স, মার্স ও উহান করোনাভাইরাস), যেগুলো মানব সম্প্রদায়ের ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করার ঝুঁকি বহন করে।
করোনার প্রাদুর্ভাব প্রথমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে শনাক্ত করা হয়। ২০২০ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৩ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ১১ মার্চ ডব্লিউএইচও এ প্রাদুর্ভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্প্রদায়ে সঞ্চালন ঘটায় বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে।
করোনার এ ভয়ানক প্রাদুর্ভাবের ফলাফল হবে বহুমাত্রিক। অনেক বোদ্ধাদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চেয়েও ভয়াবহ ফলাফল ভোগ করতে হবে বিশ্বকে। দুটি ধাপে করোনার কারণে ভয়াবহ ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে বিশ্বকে। একটি ভোগান্তি হবে করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করতে গিয়ে। অপরটি করোনার প্রাদুর্ভাব শেষ হলে বিধ্বস্ত পৃথিবী পুনর্গঠন করতে গিয়ে।
প্রথম ধাপ ইতোমধ্যে বিশ্ব অতিক্রম করছে। এতে ঝরে গেছে অনেক তাজা মূল্যবান প্রাণ। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ দেশে লকডাউন বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। জীবন যাত্রার মান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়ছে। এ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। যার ফলে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। বহু ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা বাতিল করা হচ্ছে। এ অবস্থা যত বেশি প্রলম্বিত হবে প্রথম ধাপের সমস্যা তত বেশি ঘনীভূত হবে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় ধাপের সংকটে, দ্বিতীয় ধাপের মূল সংকট হবে অর্থনীতি কেন্দ্রিক। এ ভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে পৃথিবীর ছোট-বড় বিভিন্ন রাষ্ট্রকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মহামারী সংকট কেটে গেলে পৃথিবীকে এক অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণের জন্য ভয়াবহ চ্যালেঞ্জিং সময় পার করতে হবে। যেহেতু ধনী রাষ্ট্রগুলো নিজের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকবে; সেহেতু তাদের তরফ থেকে সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা কমে যাবে। যেসব স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র এ ধরনের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, তাদেরও কঠিন সময় অতিক্রম করতে হবে। মোদ্দা কথা, বিশ্ব অর্থনীতিকে এক ভয়াবহ সময় অতিক্রম করতে হবে। আবার প্রথম ধাপের সমস্যা যত বেশি ঘনীভূত হবে তা দ্বিতীয় ধাপের সংকটকে আরও বেশি সংকটময় করবে। দুটি ধাপ একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
কাজেই নিজেদের প্রয়োজনে, অস্তিত্বের স্বার্থে এ সংকটে মানবজাতিকে ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠীর উর্ধে্ব উঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। কোনো বুজরুকি তথা মুত্রপান বা স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ অথবা ভাইরাসের সাথে স্বপ্নে কথা বলা জাতীয় প্রতারণাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কোনো ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি তথা বিশেষ ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হবে আর বিশেষ ধর্মের মানুষ মুক্তি পাবে অথবা কোনো নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো বিশেষ ধর্মের উপর নাজিলকৃত গজব জাতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তাকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। কোনো সস্তা রাজনৈতিক বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না।
ভুলে গেলে চলবে না, নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না। তাই যখন কোনো মহামারী বা দুর্যোগ আসে; তখন তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই আসে। অতএব এমন মহামারীতে বিভ্রান্ত না হয়ে যেহেতু করোনার কোনো ওষুধ নেই; তাই করোনা প্রতিরোধের সঠিক নিয়ম মেনে চলা এবং আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রত্যেক নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। করোনা এমন একটি রোগ, যেটি মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই করোনা প্রতিরোধের সঠিক নিয়ম মেনে না চলার অর্থ হচ্ছে, শুধু নিজের মৃত্যু নয়; সাথে সাথে অন্যের মৃত্যুরও কারণ হওয়া।
মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি কারো কাছে ঋণ রাখে না, আমরা যা করেছি তা-ই ফেরত পাবো। মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা আমরা চালিয়েছি, নিজেদের বিবেকবোধকে বিসর্জন দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে যেভাবে হত্যা করেছি, কূটচালের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে যেভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহের চারণভূমি বানিয়েছি, তার ফলই হয়তো আমরা ভোগ করছি এ মহামারীর মাধ্যমে।
তাই আসুন, আমরা নিজের মানবিক বোধকে জাগ্রত করি। কোনো গুজব, উন্মাদনা, উস্কানি বা বিভ্রান্তির জালে না জড়িয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধম্যে ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এ মহামারীকে মোকাবেলা করি এবং যে যার ধর্ম অনুসারে পরমকরুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে করুণা প্রার্থনা করি। তিনি যেন মানব জাতিকে এ মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করেন।
লেখক: গবেষক।
এসইউ/এমএস