অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন
বঙ্গবন্ধু নিজেই ভাষাসৈনিক ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু অনেকদিন সামনে আনা হয়নি এ ইতিহাস। ষড়যন্ত্র করে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ষড়যন্ত্রকারীরা অস্বীকার করতে চেয়েছিল। জ্ঞানপাপীর দল জানে না ইতিহাস মোছা যায় না, ইতিহাস নিজের শক্তিতেই ভেসে উঠবে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ অবদান স্পষ্ট হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু নিজেই উল্লেখ করেছেন ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম ও তাঁর ভূমিকা।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন শুরু থেকে। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চায় মুসলিম লীগ। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।’
সংগ্রাম পরিষদ গঠন হলে শেখ মুজিবসহ নেতা-কর্মীরা কাজে নেমে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিনদিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’
ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিদিনের বিষয় ছিল পুলিশের হামলা। আন্দোলন দানা বাঁধলে ১১ মার্চ শেখ মুজিবসহ ৭০-৭৫ জনকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু দমানো গেল না আন্দোলন। ১৫ মার্চ তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভায় বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন। পরবর্তীতে অনেক প্রবীণ নেতা মন্ত্রিত্বের লোভে আন্দোলন ত্যাগ করলেও বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা আন্দোলন চালিয়ে গেলেন।
১৯৫১ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৬ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী নেতাদেরও খরব দিয়েছি।...আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।...খবর পেয়েছি আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।’
১৯৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।’
সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিন ধার্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল জনগণও এগিয়ে আসবে ভাষা আন্দোলনে। কারণ জনগণ জানে রাষ্ট্রভাষা না হলে জনগণকে দাসত্বের শেকল আবার পরতে হবে। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের সাথে তার যোগাযোগ হতো নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুকে তারা খোঁজ-খবর দিতো, বঙ্গবন্ধু পরামর্শ দিতেন। এরমধ্যে তাঁকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়েছে ঢাকা থেকে। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেলে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক স্লোগান।’
ভাষার মিছিলে গুলিতে শহিদ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আপনি বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল।...আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।’
অনশনের কারণে বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। অসুস্থ বঙ্গবন্ধু গ্রামের বাড়িতে চলে যান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি জেনেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। ছোট ছোট হাটবাজারেও হরতাল হয়েছে। দেশের লোক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছাড়া উপায় নেই। কেবল তা-ই নয়, যারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বলেছে তারাও ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেছে। জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। কিন্তু শোষকরা থামেনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিবৃতি দিলে মুসলিম লীগের পত্রিকায় বিকৃতি করে ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু ২১২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম।’ এতকিছুর পরেও পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। তখন সরকার দাবি করেছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা ঢাকায় এসে পায়জামা পরে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। বঙ্গবন্ধু একাধিক প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে শাসকরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন, ১২টা ১ মিনিটের সময় আমি মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সালে যে রক্ত দেয়া শুরু হয়েছে সে রক্ত আজো শেষ হয় নাই, কবে হবে তা জানি না। আজ শহিদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না ৭ কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা বাংলার ভাইয়েরা আর শহিদ হবে না, গাজী হবে।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন শিগগিরই জনগণকে লড়তে হবে। তাই মানুষকে বারবার বলেছেন প্রস্তুত থাকতে। কারণ তিনি ছিলেন দূরদর্শী নেতা। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের শহিদ দিবসে বলেছেন, ‘আজকে শহিদ দিবসে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ ঘরে ঘরে আপনারা দুর্গ গড়ে তোলেন। আমরা সকলের সহানুভূতি, ভালোবাসা চাই।’ এ বক্তব্যের মাসখানেক পরেই বাঙালিদের ওপর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকবাহিনী। বাঙালিরাও গড়ে তোলে ঘরে ঘরে দুর্গ। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এসইউ/জেআইএম