স্মৃতি ও সম্প্রদায়
নওশাবা খুদা
‘মনে রাখি প্রতিটা শব্দ...
যত বই পড়েছি আমি…
যা আছে সামনে সব মোকাবিলায় করবে সাহায্য,
আমি শিখেছি যা কিছু…’
ব্যথার এত চমৎকার দৃশ্যায়নে আমার বাবাকে কীসে উৎসাহিত করেছিল তা নিয়ে প্রায়ই ভাবি... বেদনার মধ্যে আমরা আশ্রয় চাই, ভরসা চাই; আর সেখানেই তো জীবনের চেয়েও বিশাল একেকটি স্মৃতিস্তম্ভ।
অনেকেই শহীদ মিনার নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু শহীদ মিনার ও এর স্রষ্টা হামিদুর রহমান সম্পর্কে জানেন খুব কম মানুষই। বর্তমান বুঝতে হলে অবশ্যই এর অতীতকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে হয়, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে যারা অর্থ না জেনেই বিভিন্ন রীতি অনুসরণ করে।
সাবেক পূর্ব বাংলার (১৯৫৬ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ) রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল মূলত বাংলার রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি সামনে আনতে; বিশেষ করে শিক্ষা, গণমাধ্যম ও মুদ্রার মতো সরকারি বিষয়গুলোতে ব্যবহারের অনুমতির জন্য। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসকরা ঘোষণা দেয়, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বেলে দেয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। পুলিশ বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের হত্যা করলে আন্দোলনে নতুন মোড় আসে। এই ঘটনা জনগণের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
হামিদুর রহমান কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না। শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের, মুক্তমনা, আত্মপ্রত্যয়ী, আবেগপ্রবণ ও অনেক ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। তার অনুপ্রেরণা ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসা, এর মাটি, বাতাস আর মানুষজন। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দেশকে পরিচিতি দেয়ার জন্য একটি উপায় খুঁজছিলেন তিনি। রক্ত, ঘাম আর অশ্রুর বাইরে তিনি এমন একটি জায়গা চাচ্ছিলেন যেখানে বাংলাদেশি জনগণ সমবেদনা জানাতে পারবে, কাঁদতে পারবে বা অন্তত শান্তির জন্য বসে থাকতে পারবে।
তিনি স্কেচ করা শুরু করলেন চার শিক্ষার্থীর ভাবনা মাথায় রেখে, যারা আরও অনেক বিক্ষোভকারীর মতো শহীদ হয়েছেন। যথাযথ সম্মানের জন্য তাদের নামগুলো উল্লেখ করছি: সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার। আমার বাবা শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্ব ও সেই মা যিনি তার সন্তানদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তাদের ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। ১৯৬৩ সালে বরকতের মা হাসিনা বেগম শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
একুশের গান
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’
এই গানটি মূলত আব্দুল গাফফার চৌধুরী কবিতা হিসেবে লিখেছিলেন। পরে এর সংগীতায়োজন করেন আলতাফ মাহমুদ। প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন সারা বাংলাদেশের মানুষ খালি পায়ে দলবেঁধে এই গানটি গাইতে গাইতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যায়। তাদের পরনে থাকে সাদা-কালো পোশাক এবং হাতে ফুল ও পুষ্পস্তবক।
হামিদুর রহমান শুধু স্স্থপতিই ছিলেন না, তিনি গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন এবং তার প্রথম প্রেম ছিল তেলরঙে ছবি আঁকা। তার পড়ালেখা ছিল চিত্রকর্ম ও স্থাপত্য নিয়ে। তিনি শহীদ মিনারের ভেতরে যেখানে গ্রন্হাগারের নকশা করেছিলেন, সেখানে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি ম্যুরাল আঁকেন।
মিনারটি তৈরি হয়েছে শুদ্ধ মার্বেল পাথরে, এর সিঁড়ি ও রেলিংয়ের রঙ সাদা। দু’পাশের দেয়ালে বিখ্যাত কবিদের লেখা কবিতার লাইন দেখতে পাওয়া যায়। প্রবেশদ্বারে বসানো ভাস্কর্য দু’টি প্রাণ বিসর্জনকারীদের প্রতিনিধিত্ব করে।
শুধু পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই নয়, হামিদুর রহমানের উত্তরাধিকার বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়েও। দেশবাসীর কাছে শহীদ মিনারের গুরুত্ব এত বেশি যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে সেখানে এর স্থায়ী প্রতিলিপি তৈরি হয়েছে। লিসবন (পর্তুগাল), টোকিওতে একটি করে এবং লন্ডনে দু’টি প্রতিলিপি রয়ে শহীদ মিনারের।
ভাষা আন্দোলনে শহীদ চার ছাত্রের সঙ্গেই রয়েছে আমার বাবার কবর। সেগুলো আরেকটি স্মরণকালের শুরু মাত্র…
‘তোমার হাসিটা রেখেছি আমার জন্য…
বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত জানতেও পারবে না…
সাহসী তরুণ হাসির মানে কী…’
-নওশাবা খুদা
শিল্পের অবশ্যই চিরন্তন মূল্য থাকতে হবে।
-হামিদুর রহমান
‘আমি নীরবে দেখি তোমায়
কাঁদি নীরবে
তোমাকে ছাড়া কেটে যায় একটা জীবন
নীরবে দেখি তোমায়
নীরবে করি প্রার্থনা
সময়ের সাথে ধুয়ে যায় দিনগুলো…
লেখক: বিখ্যাত শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুর রহমানের মেয়ে
কেএএ/পিআর