সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে
সচেতনতার ফেরিওয়ালা সাঈদ রিমন। অনেক বিষয়েই তিনি মানুষকে সচেতন করে থাকেন। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ করেন। তার কাজের ধরন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
আপনি সড়ক সচেতনতা সম্পর্কে কাজ করছেন। প্রথমেই কাজের ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন—
সাঈদ রিমন: সড়কে আর কত মৃত্যুর মিছিল দেখবো আমরা। জানি, মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু কোনো অকালমৃত্যু তো কাম্য নয়। আমি মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসি। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে কাজ করছি। বলতে পারেন, একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করছি। এছাড়া স্টিকার বানিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ের উপরে লাগিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ হাতে নিয়েছি।
কবে থেকে এ কাজ করছেন?
সাঈদ রিমন: দীর্ঘ সাত বছর যাবত মানুষকে সচেতন করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। আমি মনে করি, প্রাইমারি স্কুল থেকেই শিশুদের সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
কোন ঘটনা আপনাকে নাড়া দিচ্ছে বা এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে?
সাঈদ রিমন: বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ জন মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। তাদের মধ্যে একজন, মৃত্যুর সময় তার বুকে আমার হাত ছিল। তার স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ওই সন্তান পৃথিবীতে আসার পর আর বাবার মুখ দেখা হয়নি। কতটা দুঃখজনক ঘটনা, যা আজও মানতে পারছি না। কিছুদিন আগে দুই সন্তান রেখে সগীর ভাই নামে একজন নিহত হলেন। কত বাবা-মা তাদের সন্তান হারাচ্ছেন। সন্তান তার বাবা-মাকে অকালেই হারাচ্ছে। কয়েক দিন আগে ইয়াসমিন সুলতানা নামের একজন তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাকে জানালেন। বললেন, সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মাকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি। এসব ঘটনাই আমাকে নাড়া দিচ্ছে এবং উদ্বুদ্ধ করছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। সে ক্ষেত্রে সচেতনতার ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
সাঈদ রিমন: ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা যখন বাড়িতে সন্তানদের সময় দেই; তখন পারিবারিক আলোচনার একটি বিষয়বস্তু হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা। তাতে শিশুরা আস্তে আস্তে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা তার সন্তানকে মোটরসাইকেলে করে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু বাবা হেলমেট ব্যবহার করলেও সন্তানের জন্য হেলমেট রাখেন না। আরও দেখা যায়, বাবা-মা দু’জনই হেলমেট পড়ে আছেন, তাদের মাঝখানে সন্তানকে বসিয়ে রাখেন হেলমেট ছাড়া। আমার প্রশ্ন হলো- তাহলে আপনার সন্তান আপনার কাছ থেকে কী শিখলো!
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কেমন সচেতনতা জরুরি বলে মনে করেন?
সাঈদ রিমন: শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাদের যেভাবে গড়ে তুলবেন; সেভাবেই গড়ে উঠবে। সন্তান যখন স্কুলে যায়; তখন যেসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে, তা হলো:
১. সড়ক আইন সম্পর্কে জানানো
২. ট্রাফিক সিগন্যালগুলো সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দেওয়া
৩. রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং বা ওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে বলা
৪. রাস্তায় দেখে-শুনে পথ চলা, খেলাধুলা বা দৌড়াদৌড়ি থেকে বিরত থাকা
৫. স্কুলে একটু আগেই পাঠানো, যাতে তাড়াহুড়া না করতে হয়
৬. প্রতিদিন বাড়িতে ৪-৫ মিনিটের জন্য হলেও সন্তানের সাথে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক আলোচনা করা
৭. রাস্তা পারাপারে বাঁক বা মোড় ব্যবহার না করা। কারণ সেখানে অপর পাশ থেকে গাড়ি আসলে দেখা যায় না
৮. যেসব স্থানে জেব্রাক্রসিং নেই; সেসব স্থানে সিগন্যাল মেনে গাড়ি থামালে দেখে-শুনে রাস্তা পার হওয়া
৯. সাধারণত স্কুলে যাওয়ার সময় বাচ্চারা একসাথে জটলা বেঁধে হেঁটে যায়। ওই সময় তারা অনেকটা অসচেতন থাকে। তখন যেন ডানে-বামে, সামনে-পেছনে যানবাহন আছে কি-না, সেটা খেয়াল করে।
১০. রাস্তায় সন্তানকে নিয়ে চলাচলের সময় নিজেরাও সচেতন থাকা।
কোথায় কোন শ্রেণির মানুষের মধ্যে এ কাজ করছেন?
সাঈদ রিমন: আমি অফিসে যাওয়া-আসার পথে বা অবসরে গাড়ি চালক, শ্রমিক, পথচারী, যাত্রীদের নিয়ে প্রতিদিন বাসে, রেল স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্যাম্পেইন করি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করি।
আপনার এ কাজে কেমন সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন?
সাঈদ রিমন: রাজশাহী থেকে আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও আরাফাত রুবেল, ঢাকা থেকে ইশতিয়াক আহমেদ মুনীর তাদের সন্তানদের এ কাজে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারাও মনে করেন, এখন থেকেই সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জানাতে হবে। বলতে গেলে অনেক সহযোগিতা পাচ্ছি। বিভিন্ন গণমাধ্যমও সহযোগিতা করছে।
এ কাজে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাঈদ রিমন: আমার মনে হয়, পাঠ্যপুস্তকে সড়ক আইনসহ দুর্ঘটনা রোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিকল্প নেই। তাই সিলেবাসে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া আগ্রহী অভিভাবকদের সন্তান নিয়ে নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে ছোটবেলা থেকেই তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমার সাথে স্কুলের ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করবে।
এসইউ/পিআর