সেই রোকেয়া খাতুনই আজ নারী জাগরণের অগ্রদূত
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। মহিয়সী নারী হিসেবে পরিচিত হওয়ার জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু দুর্গম পথ। দুঃখে জর্জরিত ছিল তাঁর জীবন। তবুও হয়েছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জীবন সংগ্রাম এবং পরবর্তী নারীদের হালচাল নিয়ে লিখেছেন মরিয়ম আক্তার—
জন্ম: সময়টা ছিল ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নিসা সাবের চৌধুরীর কোল আলোকিত করে পায়রার পালকের মত যে শিশু জন্ম নেন; তিনিই বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত। বেগম রোকেয়ার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন হলেও তিনি বেগম রোকেয়া নামেই পরিচিত।
সংগ্রাম শুরু: অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারপূর্ণ বাংলাদেশে আলোর দিশারি হয়ে জন্ম নেন বেগম রোকেয়া। বাংলার নারীরা তখন ছিলেন গুরুত্বহীন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন দ্বিতীয়। তখনকার দিনে চার দেয়ালে বন্দি থাকতে হতো নারীদের। রোকেয়ার ক্ষেত্রেও তা-ই ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার জীবন ছিল কষ্টের। পাঁচ বছর বয়সে একবার কলকাতা যাওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু তা-ও নিজেকে আড়াল করে, ভারি কাপড় পরিধান করে পালকিতে চড়ে। রোকেয়া তাঁর ‘অবরোধ বাসিনী’র উৎসর্গপত্রে নিজের জীবনের কষ্টের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
শিক্ষালাভ: তখন নারী শিক্ষা ছিল কল্পনার বাইরে। জমিদার বাড়ির মেয়ে হিসেবে ছোটবেলায় রোকেয়াকে কিছু অক্ষরজ্ঞান শিখিয়েই লেখাপড়ার অবসান ঘটানো হয়। কিন্তু রোকেয়া ছিলেন লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহী। তাঁর বড় দুই ভাই নারী সমাজের পরিবর্তনের কথা ভেবে ছোট বোনের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে থাকেন। গভীর রাতে মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় চলতো ভাই-বোনের শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা। বড় ভাইয়ের ছুটি শেষ হলে চলে যেতেন কলকাতায়। ছোট বোন রোকেয়া বসে বসে দিন গুনতেন ভাইয়ের আগমনের। ভাই কলকাতায় চলে গেলে রোকেয়া অতি মূল্যবান বই লুকিয়ে রাখতেন পরম যত্নে। ভাই এলেই আবার শুরু হতো রাত জাগানো সেই প্রচেষ্টা। এভাবেই বহু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে রোকেয়া অর্জন করেছেন শিক্ষা।
কর্মজীবন: কৈশোরে পা দিতেই মাত্র ষোলো বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে নিজের থেকেও দ্বিগুণ বয়সী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শাখাওয়াত ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। রোকেয়ার আগ্রহ দেখে তিনি শিক্ষা গ্রহণে অনেক সাহায্য করেছিলেন। মাত্র ১৪ বছরের সাংসারিক জীবনে সাখাওয়াৎ গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়া রোকেয়া স্বামীর আত্মীয়দের অত্যাচারে কলকাতায় ফিরে যান। শত কষ্টের মাঝেও নিজেকে তৈরি করেন নতুনভাবে। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে মাত্র আটজন ছাত্রী আর দু’টি বেঞ্চ নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। হাজার বাধার পরও তিনি পিছপা হননি।
নারী জাগরণে ভূমিকা: রোকেয়ার সারা জীবনের সংগ্রামের উদ্দেশ্যই ছিল নারীদের অধিকার। নারী অধিকার নিয়ে সব সময় লড়ে গেছেন। তাঁর মনের ভেতর সব সময় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো, ‘নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক ভিন্নতা থাকলেও সৃষ্টির উদ্দেশ্য তো এক। তাহলে এত বিভেদ কেন?’ এ প্রশ্নের সমাধানের জন্যই রোকেয়ার জীবন সংগ্রামী হয়ে উঠেছিল। এতে সফলও হয়েছেন। আগে সমাজের ভাবনা ছিল নারী শুধু সংসার আর রান্না করার মাঝেই সীমাবদ্ধ। রোকেয়া বদলে দিয়েছেন এসব মানুষের চিন্তা-ভাবনা। তাঁর লেখনিতে প্রকাশ করেন, ‘আমিও দেখাইতে চাই যে, দেখো তোমাদের ঘর করা ছাড়া আমাদের আরো পথ আছে। মানবজীবন খোদাতালার অপূর্ব দান। তাহা শুধু রাঁধা, উনুনে ফুঁপ পাড়া আর কাঁদার জন্য অপব্যয় করবার জিনিস নহে।’ বর্তমান নারীদের মধ্যে এমন প্রতিবাদী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে কেবল রোকেয়ার সেই সাধনার ফলে। আর রোকেয়া সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন নারীর এমন মনোভাবের জন্য।
নারীদের শিক্ষালাভ: রোকেয়ার সারা জীবনের সংগ্রাম একেবারে বৃথা যায়নি। নিজের জীবনকে যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে উপভোগ করেননি তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়েছেন। সব সময় প্রাণপণে লড়াই করেছেন। তিনি নারীদের লড়াই করতে শিখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন, কীভাবে সমাজে মাথা উঁচু করে নারীদের চলতে হয়। আরও শিখিয়েছেন, কীভাবে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। রোকেয়া দূর করেছিলেন কুসংস্কার। নারীরা শুধু রাঁধুনী নয়, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। রোকেয়ার জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্রকে ধারণ করছে নারীরা।
বর্তমান নারী জাগরণ: কিছু নারী আছেন; যারা তাদের কর্মগুণে পৌঁছে গেছেন দেশের উচ্চ পদে। কিছু নারী অধিকার বঞ্চিত হয়েও চেষ্টা, সাধনা ও আত্মবিশ্বাসের জোরে পৌঁছে গেছেন সফলতার চূড়ায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপর্ণ পদেই এখন নারী। এ থেকেই বোঝা যায়, বেগম রোকেয়ার সারা জীবনের চেষ্টা বৃথা যায়নি। আমাদের দেশে উচ্চ শিখরে আজ নারীদের স্থান।
নারীর প্রতিবন্ধকতা: বেগম রোকেয়ার স্বপ্নগুলো বর্তমানে হুমকির মুখে। চারিদিকে শুধু ধর্ষণ আর নির্যাতনের খবর। এতকিছুর পরও নারী অধিকার শূন্যের কোটায়। বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছাটুকু থেকেও বঞ্চিত। শুধু অধিকারই নয়, তারা নিরাপত্তাহীনও। রাস্তায় ঠিকমত চলাচলেরও নিরাপত্তা নেই তাদের। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার সময় শত বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কখনো রাস্তার বখাটে ছেলেদের ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেককে প্রাণও হারাতে হয়। এখনো বাল্যবিবাহের কারণে ধুলায় মিশে যায় সুন্দর স্বপ্নগুলো।
লেখক: শিক্ষার্থী, কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর।
এসইউ/পিআর