২০৩০ সালের মধ্যে এইডস নির্মূল সম্ভব
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের মাধ্যমে এইডস নির্মূল করা সম্ভব। কিছুদিন আগে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত হওয়া এইডস বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে এমনই জানিয়েছেন এইডসের সঙ্গে কাজ করা বিভিন্ন দেশের গবেষকরা। গুটি বসন্তের মত এইডসকেও পৃথিবী থেকে নির্মূল করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনের সেই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন ডা. মারুফ হাসান-
হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা সংক্ষেপে এইচআইভি সংক্রমণ থেকে এইডস মহামারীর মত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশ এ রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয় ১৯৮৫ সাল নাগাদ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধ এবং জনগণের সচেতনতার কারণে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতায় বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে রোগটিকে বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় তেরো হাজারের উপরে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ রোগে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ, সংখ্যার হিসাবে যা ১৬ লাখের উপরে। তবে এইডস নিয়ে শঙ্কা আছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৬০ জনের বেশি এইডস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া এইচআইভি পরীক্ষা করা যায় না, তাই শরণার্থীদের মধ্যে সবার ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে শরণার্থীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ মহামারী আকার ধারন করতে পারে।
> আরও পড়ুন- কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য : বিবেকানন্দ ঝা
এইডসের চিকিৎসার জন্য বর্তমান বিশ্বে অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি প্রচলিত আছে। অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি হলো এইচআইভি ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণকারী একটি ওষুধ। অনেক ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত এ চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে এইডসের রোগীদের দেহে এইচআইভির পরিমাণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সেইসাথে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের প্রায় গড়ে ২৫ বছরের বেশি সময় বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ভাগ্যবান রোগী এখন পাওয়া যাচ্ছে; যারা এইডস নিয়ে ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছেন। এইডস মোকাবেলায় আগামীতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি। এইডসের প্রতিষেধক পরীক্ষামূলক ব্যবহার, এইডসের সাথে ক্যান্সার ও হেপাটাইটিসের চিকিৎসা এবং নিজের লালা থেকে বাসায় বসে এইডস নির্ণয়ের ব্যবস্থা।
এইডসের বৈশিষ্ট্য হলো- ধীরে ধীরে মানবদেহেরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানে এবং মানবদেহকে বিভিন্ন অণুজীবের আক্রমণ ও বিস্তারের অভয়ারণ্য করে দেয়। যে কারণে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি মূলত বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করে থাকে। এইডস চিকিৎসায় অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি দেওয়া হয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো- এটি দেহে ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে এনে নিয়ন্ত্রিত রাখে। যাতে এটি দেহেরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর কোন আঘাত হানতে না পারে। প্রচলিত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি হলেও গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপিকে আরো বেশি নিরাপদ করা হয়েছে।
বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি চিন্তিত সমস্যা হলো- সংক্রামক রোগব্যধি। জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলো থেকে সংক্রামকব্যধি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এবং মানব সভ্যতাকে নিয়ে যাবে হুমকির মুখে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস বা পরজীবীর মত যে কোন অণুজীবের ব্যাপক সংক্রমণ যে কোন সময়েই বিপদ ডেকে আনার মত অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে আগামীতে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান বা মিয়ানমারের অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহার দিন দিন ব্যাকটেরিয়াকে করে তুলছে অপ্রতিরোধ্য।
উপমহাদেশের এসব দেশে এই ওষুধগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন বেচাকেনা আর মানুষের অসচেতনতা আমাদের দিন দিন আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিএসএমএমইউসহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত রোগীদের কালচার রিপোর্টে পাওয়া যাচ্ছে মাল্টিপল ড্রাগ রেসিস্টেন্ট ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব। অর্থাৎ দেশে প্রচলিত ওষুধ দিয়ে দমানো যাচ্ছে না এসব জীবাণুদের। একদিকে বাতজ্বর, টাইফয়েডের মত রোগের জন্য দায়ী এসব সাধারণ অণুজীব দিন দিন হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য। অন্যদিকে এদেরকে ঠেকানোর মত শক্তিশালী কোন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে পারছে না নতুন ওষুধ তৈরির সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।
বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ। এজন্য তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ অনুসরণ করে আসছে। এরমধ্যে বিভিন্ন কূটকৌশলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অপব্যবহার করার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এসবের বাইরে আরেকটি বিষয় যা নিয়ে তারা উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে থাকে, তা হলো তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কিন্ত এই ব্যাপারটিকে সিমবায়োসিস বা উভয়েরর জন্যই লাভজনক বলে বিবেচনা করা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইউরোপের দেশগুলো বর্তমানে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় অনেক বেশি অংশগ্রহণ করছে। তাদের গবেষণাগুলোতে ভালো সাফল্য আসছে। কিন্তু কোন কোন দেশের সরকার এইডস বিষয়ক গবেষণায় তাদের বাজেটের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। গত বছর প্যারিসে এই বাজেট হ্রাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে জনগণ।
সম্মেলনের শেষদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাদের এইচআইভি প্রতিরোধী ফাউন্ডেশনের কার্যপদ্ধতি ও গৃহীত বাজেটে এইডসের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ কমানোয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এইডস রোগী এবং এইডস নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবক, গবেষক, সমাজকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে পড়েন। পরবর্তীতে বিল ক্লিনটন ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেন। আন্তর্জাতিক সাহায্যের অংশ হিসাবে টিবি, এবোলা, সোয়াইন ফ্লু বা এইডসের মত রোগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো উন্নত বিশ্বের বা স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে অনেক ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকে।
> আরও পড়ুন- গাড়িতে ঘুম এলে যা করবেন
সম্মেলন থেকে বোঝা গেল, পর্যাপ্ত আর্থিক আর কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে এ ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এইডস নির্মূলে সম্পৃক্ত সবাই মনে করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এরজন্য বর্তমানে রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনা, ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা বা পিআরইপির (PrEP–Pre Exposure Prophylaxis) মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার সাথে সাথে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। আর সেই সাথে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে এইডস শনাক্তকরণে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করার দিকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়। মাত্র ১০ বছর আগেও এইডসকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়েই গলদঘর্ম হয়েছে উন্নত রাষ্ট্রগুলো, সেখানে এখন একে নির্মূল করা নিয়ে পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। তাই এইডসকে গুটি বসন্তের মত চিরতরে বিদায় করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সরকারের প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।
এসইউ/এমকেএইচ