বেকারিতেই শেষ বেকারত্ব
বেকারত্ব তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। বেকারত্বের যন্ত্রণা বেকাররাই ভালো জানেন। ফলে তার মনে বেশ জেঁকেই বসেছিল উদ্যোক্তা হওয়ার নেশা। সেই নেশা তাকে আজ করেছে একজন সফল উদ্যোক্তা। আজ তিনি খুশি, খুশি তার পরিবার। তারই মেধা আর পরিশ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থানও হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মোহাম্মদ হেলালুজ্জামান-
দেলদুয়ার উপজেলার এলাচিপুরের ছেলে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোল্লা। তিনি ইমরান বেকারির স্বত্বাধিকারী। সমবয়সীরা একে একে যখন বিদেশ চলে যাচ্ছে। পরিবারও তাকে বারবার বলছিল, একটা কর্মসংস্থান প্রয়োজন। বারবার বলা হচ্ছিল বিদেশ যাওয়ার জন্য। কৃষক বাবার কম আয়ে পরিবারের মধ্যে টানাটানি লেগেই থাকতো। কিন্তু বিদেশ যেতে মন কোনভাবেই যেন সায় দিচ্ছিল না।
সংসারের প্রয়োজনে তাকে দুবাই, কাতার বা সৌদি আরব যেতে হবে। প্রস্তুতি চলছে পারিবারিকভাবে। কিন্তু তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ভিন্ন কিছু, অন্য স্বপ্ন। মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, বাড়ির পাশে ছিল একটি বন্ধ হওয়া বেকারি কারখানা। তার নজর শুধু ওই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার দিকে। পরিবারকে বললেন, বিদেশ যেতে লাগবে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। এতো টাকা দিয়ে বিদেশ গিয়ে আশানুরূপ ফল না পেলে সবাই বিপদে পড়বেন।
এতো টাকার জোগান দেওয়াও তার পরিবারের পক্ষে বড়ই কঠিন। তিনি বাবা-মা, বড় ভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ১৫-২০ হাজার টাকা হলেই দেশে সুন্দর একটি ব্যবসা করা যেতে পারে। তার পরিকল্পনার কথা সবাইকে জানালেন। বন্ধ হওয়া বেকারি কারখানা ভাড়া নিয়ে চালানোর কথা শুনে একবাক্যে জানিয়ে দিলেন, এটা অসম্ভব। এতে সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। পরিবার থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো, এ কাজের জন্য তাকে কোন টাকা দেওয়া হবে না। তাকে বিদেশ যেতেই হবে, ভালো কিছু করার জন্য।
> আরও পড়ুন- বাদাম বিক্রির টাকায় ভাইকে পড়াচ্ছেন মোজাহার
অদম্য যুবক আনোয়ার তার সিদ্ধান্তে অটল। কারো ভিন্ন যুক্তি-পরামর্শ মানতে সে নারাজ। সেটা অবশ্য ২০০৫ সালের কথা। কাছের লোকদের বাধা সত্ত্বেও এক দুঃসাহসিক পথে যাত্রা তার। বুকে অনেক সাহস ও মনোবল নিয়ে জীবনের যুদ্ধে নেমে পড়েন। তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে বন্ধ হওয়া বেকারি কারখানাটি। তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে পরিকল্পনা আর সফল উদ্যোক্তা হওয়ার নেশা।
পরিবারের মতামত উপেক্ষা করে মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়ে বন্ধ কারখানায় শুরু করেন ব্যবসা। ‘ইমরান বেকারি কারখানা’ থেকে আজ নিজস্ব জমিতে নিজস্ব ভবনে তার কয়েক লাখ টাকার প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাজ করে ৯-১০ জন দক্ষ-অদক্ষ জনবল।
আনোয়ারের কর্মচারী রফিক, শিমুল, শফিক ও মুহুরুদ্দি বলেন, ‘এখানে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বোঝা যায় না কে মালিক আর কে শ্রমিক। সবার আন্তরিক পরিশ্রমের ফসল আজকের এই ইমরান বেকারি।’
আনোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, তার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার রুটি, কেক, বিস্কুট উৎপাদন হচ্ছে। তবে কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় লাভও অনেক কম। তবুও সবার মুখে আনন্দের হাসি। নিয়মিত কর্মচারী ছাড়াও কমিশনে বিক্রির কাজ করে প্রায় ৭-৮ জন।
> আরও পড়ুন- সুপারির খোল দিয়ে বাসন তৈরি করছেন ইমরান
এলাচিপুরের হাসেম মিয়া, টুকচাঁনপুরের মোয়াজ্জেম হোসেন, কুমারজানীর পরশ, দেলুয়াকান্দির মাসুদ প্রায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সাথে জড়িত। প্রতিদিন খুব সকালেই বের হয়ে যান নিজস্ব বাহন নিয়ে। পার্শ্ববর্তী বা দূর-দূরান্তের বাজারে নতুন অর্ডার নেওয়া আর পণ্য পৌঁছে দেওয়াই তাদের কাজ।
আনোয়ারের প্রতিষ্ঠান দিন দিন উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। আনোয়ার হোসেন স্বপ্ন দেখেন, একদিন অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান হবে ইমরান বেকারিতে। ইতোমধ্যে তার কারখানায় যুক্ত হয়েছে কিছু অটোমেটিক মেশিন। তবে গ্রামে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় মেশিনগুলো চালানো কঠিন। তার স্বপ্ন আগামীতে সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় মেশিন দিয়ে পণ্য উৎপাদন করবেন।
তিনি আরও জানান, এই শিল্পে এখনো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অনেক ঘাটতি আছে। সরকারিভাবে যদি থানা বা জেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বেকারি শিল্পের দক্ষ জনবল তৈরির ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়, তাহলে বেকারি শিল্পে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
তারা সঠিক প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে আন্তর্জাতিক বাজারেও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া সহজ শর্তে ব্যাংক লোনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে।
এসইউ/এমকেএইচ