সবার কাছে তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা
বিভিন্ন কাজের কারণে প্রতিদিনই তাকে ছুটে যেতে হতো উপজেলা বা জেলা শহরে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ হওয়ায় জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কখনোই পার্থক্য খুঁজে বেড়াননি তিনি। তার বাইকের পেছনের আসনটি কখনোই খালি থাকতো না। রাস্তায় যাকে দেখতেন, তাকেই বসাতেন বাইকে। সততা, নিষ্ঠা আর কর্তব্যপরায়ণতার কারণে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তার নাম আবদুল বারেক মিয়াজী। এলাকার সবাই ডাকতেন বারী মিয়াজী বলে। তার জীবন সংগ্রামের গল্প লিখেছেন রিফাত কান্তি সেন-
একজন বারী মিয়াজী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে লালন করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে ছিলেন আবদুল বারী মিয়াজী। মৃত্যুর পরও তাই সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে পেরেছেন। ছোট থেকে বড় সবাই একনামে চিনতেন প্রবীণ এ রাজনীতিবিদকে। বারী মিয়াজী নামটি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর শাশীয়ালীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। তার জীবনাবসান হয় ২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর।
শিক্ষা জীবন: বারী মিয়াজী মামা বাড়ি থেকেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি নেন। যদিও তার মূল বাড়ি ছিল ফরিদগঞ্জের ৭ নম্বর দক্ষিণ পাইকপাড়া ইউনিয়নের শাশিয়ালী গ্রামে। কিন্তু তার শিক্ষা জীবন কাটে ফরিদগঞ্জের কেরোয়া গ্রামে তার মামা বাড়িতে। উপজেলার গাজীপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকার তেজগাঁও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং পারিবারিক কারণে তিনি গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করতে পারেননি। তবে তেজগাঁও কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্র সংসদের এজিএস ছিলেন।
কর্মজীবন: তিনি ঢাকার তেজগাঁওয়ে মেসার্স রাজা অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার পদে অনেক দিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে গাজীপুর জেলার (বর্তমান গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন) টঙ্গী থানায় ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মের্সাস বারেক অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও ছিদ্দিক ট্রান্সপোর্ট ও চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ফরিদগঞ্জ বাজারে মেসার্স মাসুদ অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
পারিবারিক জীবন: তার স্ত্রীর নাম রোকেয়া বেগম। ছেলে মো. আল মাসুদ মিয়াজী বর্তমানে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে কর্মরত। বড় মেয়ে বাবেয়া আক্তার নয়ন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে একটি স্কুলে কর্মরত। ছোট মেয়ে তাহমিম বারী স্বাস্থ্য সংস্থ্যা মেরিস্টোপসে কর্মরত।
> আরও পড়ুন- নারীদের আশ্রয়স্থল এসপি শামসুন্নাহার
রাজনৈতিক জীবন: তিনি স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার একমাত্র মামা মো. সিরাজ মিয়ার (পরবর্তীতে শ্বশুর) হাত ধরেই রাজনীতিতে আসেন। শ্বশুর ছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাজার কমিটির সভাপতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সিরাজ মিয়া ও রাজা মিয়ার (আওয়ামী লীগের নির্বাচন করেছিলেন ১৯৭০ এবং ১৯৮৬) হাত ধরে ফরিদগঞ্জে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সিরাজ মিয়া অসুস্থ এবং রাজা মিয়া মারা যাওয়ার পর ফরিদগঞ্জ আওয়ামী লীগে দুঃখের সময় তিনি হাল ধরেন। যখন কোন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিল না; তখন তিনি সেই সংগঠনকে নিজের শ্রম, আর্থিক সহায়তা ও নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অফিসের জায়গায় দিয়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে তোলেন। তিনি তিনবার ফরিদগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়াও ঢাকার রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। টঙ্গী থানা আওয়ামী লীগের (কেন্দ্রীয়) সদস্য এবং স্বাধীনতা উত্তর তেজগাঁও ট্রাক মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন।
রাজনৈতিক বঞ্ছনা: ১৯৮৯ সালে জাহাজ মার্কা নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও ক্ষমতায় যেতে পারেননি। রাজনীতিতে ব্যাপক অবদান থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে তিনি বারবার দলীয় কোন্দলের শিকার হন এবং জাতীয় নির্বাচনে বারবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু ফরিদগঞ্জবাসীর ভালোবাসায় তিনি জনগণ থেকে সরে আসতে পারেননি। জনগণের ভালোবাসায় দুই-দুইবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সর্মথন ছাড়াই অংশগ্রহণ করেন। বিপুল ভোটে দলের অন্যান্য প্রার্থী থেকে এগিয়ে থাকলেও বরাবরই দলীয় কোন্দলের শিকার হওয়ার কারণে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি বলে মনে করেন তার পরিবারের সদস্যরা।
একজন ভালো মানুষ: তিনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ ছিলেন। সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্ভীক ও জনগণের ভালোবাসায় আসক্ত একজন ভালো মানুষ। বারী মিয়াজী ছিলেন অত্যন্ত সাদামনের একজন মানুষ। তার একটি মোটরসাইকেল ছিল, যা ছিল ফরিদগঞ্জের প্রাণ। তিনি এই মোটরসাইকেল নিয়ে প্রত্যেক ইউনিয়নে যেতেন কর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে। যাওয়ার সময় রাস্তায় কাউকে হাঁটতে দেখলে তাকে মোটরসাইকেলের সঙ্গী বানিয়ে নিতেন। সে যে-ই হোক না কেন। আর সে জন্য মানুষ তাকে ‘গরিবের বন্ধু’ বলেও আখ্যা দিত। অনেক ছাত্রকে তিনি মোটরসাইকেলে সঙ্গী বানিয়ে স্কুল-কলেজে পৌঁছে দিয়েছেন।
মানবতার ফেরিওয়ালা: বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এ সৈনিক ছিলেন অসহায়ের বন্ধু। কেউ যদি মারাত্মক অসুস্থ থাকতেন, তবে তার কাছে ছুটে যেতেন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য নিজ খরচে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। অনেকের লেখাপড়ার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। অনেক গরিব শিক্ষার্থীকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতেন। বহু বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অসচ্ছ্বল পরিবারের মেয়ের বিয়ের জন্য আর্থিকভাবে ও বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন সামজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমৃত্যু জড়িত ছিলেন। তিনি শাশিয়ালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, দক্ষিণ শাশিয়ালী এমএ বারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ফরিদগঞ্জ উপজেলা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর কুমিল্লা সমিতি, চাঁদপুর জিলা সমিতিসহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
> আরও পড়ুন- বিদ্যালয়ে মহানুভবতার দেয়াল
জনতার কথা: সাধারণের কাছে অসাধারণ হয়ে ওঠা বারী মিয়াজীকে ঘিরে জনগণের রয়েছে অফুরন্ত ভালোবাসা। এলাকাবাসীর মধ্যে বজেন্দ্র লাল মিত্র বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন একসাথে সময় কাটিয়েছি। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। সাধারণ জনগণ তাকে খুবই ভালোবাসতো।’ শাহ আলম দর্জি বলেন, ‘আমি অনেকবার তার মোটরসাইকেলে চড়েছি। আমার জানামতে, তার মোটরসাইকেলের পেছনের সিটটি কখনোই খালি থাকতো না।’
পরিবারের বক্তব্য: তার ছেলে আল মাসুদ মিয়াজী বলেন, ‘আব্বা মারা যাওয়ার পর এখন আর দলের কেউই তেমন খোঁজ-খবর নেন না। তিনি জীবিত থাকতেও একই পরিস্থিতি হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভালোবাসি বলেই হয়তো আজ আমাদের এ দশা। তবে আমরা আশা করবো যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে আব্বাকে সম্মানিত করা হয়।’
এসইউ/জেআইএম