পনিরের পুলিৎজার বিজয়ের গল্প
সাংবাদিকতায় অস্কার খ্যাত পুরস্কার ‘পুলিৎজার’ পেয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। রয়টার্সের পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশি সাংবাদিক মোহাম্মদ পনির হোসেন। এ বছর আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও ফটোগ্রাফিতে সংস্থাটি এ পুরস্কার পায়। আর এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি এ পুরস্কার পেলেন। পনিরের পুলিৎজার বিজয়ের গল্প শোনাচ্ছেন আদীব মুমিন আরিফ-
গত সেপ্টেম্বরে একটি ছবি সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব মানবতার ভীত। ছবিটি ছিল মৃত শিশুকে বুকে নিয়ে কান্নারত এক রোহিঙ্গা মায়ের চুমো খাওয়ার দৃশ্য। মায়ের ভালোবাসার কাছে সন্তানের লাশ কোন ভেদরেখা টানতে পারেনি। ছবিটি বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে মায়ের ভালোবাসার গভীরতা আর বিশ্ব মানবতার নগ্নরূপকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। ছবিটির স্রষ্টা বাংলাদেশের মোহাম্মদ পনির হোসাইন। ছবিটিই তাকে এনে দেয় সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। বিশ্বে সাংবাদিকতার সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার পুলিৎজার। এবছর ফটো সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার কর্তৃপক্ষ রয়টার্সের সাত সাংবাদিকের ষোলোটি ছবি নির্বাচন করে। সেখানে এ ছবিটিসহ বাংলাদেশের পনিরের মোট তিনটি ছবি স্থান পায়। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পুলিৎজার পুরস্কারের ইতিহাসে নাম লেখান।
ছবির গল্পে পনির হোসাইন বলেন, ‘দিনটি ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। আমি কক্সবাজারের শাহপরির দ্বীপে যাই ছবি তোলার জন্য। নৌকায় করে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের দৃশ্য খুঁজছিলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কোন নৌকার দেখা পাইনি। হাঁটতে হাঁটতে এক মাইল সামনে এগিয়ে যাই। তখন হঠাৎ এক সিএনজি চালক বললেন, ওইখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি নৌকা ডুবেছে। সেই সিএনজিতে করেই আমরা দ্রুত সেখানে যাই। সেখানে অনেকের স্বজন হারানোতে কান্না করছিল। তখন এই দৃশ্যটি আমার চোখে পড়ে। নৌকাডুবিতে মৃত শিশুকে বুকে নিয়ে মা কান্না করছে আর চুমো খাচ্ছে। হৃদয় বিদারক দৃশ্যটি আমাকেও ব্যথিত কর। কিন্তু পেশাগত কারণে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে দৃশ্যগুলো আমি ক্যামেরায় ধারণ করি। রাতে রুমে ফিরে যখন ছবিগুলো এডিট করছিলাম; তখন আমি চোখের পানি আটকাতে পারিনি।’
ফটো সাংবাদিকতার প্রতি পনিরের প্রথম আগ্রহ সৃষ্টি হয় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়। পত্রিকার পাতায় নানা ছবি তাকে আকর্ষিত করেছিল। ভাবছিলেন এই পেশাটা অনেক মজার। নয়টা টু ছয়টা অফিস করার কোন ঝামেলা নেই। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ছবি তোলাই কাজ। এরপর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ে পড়ার সময় ২০০৯ সালে নর্থ সাউথ ফটোগ্রাফি ক্লাব আয়োজিত ফটো কর্মশালায় তার প্রথম হাতেখড়ি। ২০১০ সালে কেনেন প্রথম ক্যামেরা ‘নিক্কন ডি-৯০’।
ফটোগ্রাফিতে পনিরের প্রথম সাফল্য ছিল ২০১৬ সালে সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফিতে জাতীয় পর্যায় দ্বিতীয় হওয়া। পনির প্রথম কাজ শুরু করেন ইউএসএ’র জুমা প্রেসের সাথে ২০১৫ সালে ফটো কন্ট্রিবিউটর হিসেবে। একই সময় ইতালির নূর ফটোগ্রাফিতেও কন্ট্রিবিউটর ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত থমসন রয়টার্সে ফটোগ্রাফার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই। রয়টার্স’র এশিয়া ফটো এডিটর ইনচার্জ আহমাদ মাসুদের মাধ্যমে যোগদান করেন। শুরু হয় রয়টার্সের সঙ্গে পথ চলা। নিয়োগের পর পরই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ছবি তুলতে যান। এরপর সংকটময় মুহূর্তে ছবি তোলার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে প্রশিক্ষণ নেন।
ফটোগ্রাফিতে তিনি বিখ্যাত অনেক ফটোগ্রাফারকেই অনুসরণ করেন। এরমধ্যে ব্রাজিলের সেবাস্টিয়াও সালগাদো, মধ্যপ্রাচ্যের মুহাম্মদ মুহেইসেন, বাংলাদেশের জি এম বি আকাশ, এম আর হাসানসহ অনেককেই। ছবির জন্য ভালো লাইট পাওয়ার জন্য তিনি সাধারণত সকালে ও বিকেলে বের হন। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন তাকে লাইফস্টাইল, প্রকৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছবি তুলে পাঠাতে হয়। ছবি তোলা, ছবির ভাষায় কথা বলা তার নেশা ও ভালো লাগার বিষয়। তাই পেশা হিসেবে তিনি ফটোগ্রাফিকে বেশ উপভোগ করছেন। কাজের জন্য কোন চাপ নয়। বরং ভালো লাগা থেকেই কাজগুলো করে থাকেন।
পনিরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মুন্সীগঞ্জের বাসাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের খাজা আজমেরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০০৭ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১২ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও ভালো ফলাফল না হওয়ায় হতাশ হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালে স্নাতক শেষ করেন।
ফটো সাংবাদিকতার জন্য ২০১৬ সালে ফুল স্কলারশিপে ফিলিপাইনের এটেনিও ডি ম্যানিলা ইউনিভার্সিটি থেকে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজম বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন। সেখানে তিনি ফটো সাংবাদিকতার বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ও ইথিক্স আয়ত্ত করেন।
পনিরের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থানার গুয়াখোলা গ্রামে। বাবা মো. জামাল উদ্দিন ব্যবসায়ী ও মা এলিজা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে পনির তৃতীয়। পনিরের ইচ্ছা রয়টার্স’র প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কাভার করা।
এসইউ/পিআর