ফুলবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা
১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়ই আটা গ্রামের ২৫৯তম ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা। আড়াইশ’ বছরের এতিহ্যবাহী খেলাটি নিয়ে লিখেছেন এবিএম সোলায়মান-
ব্রিটিশ শাসনামলে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্ত এবং ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমির বিরোধ মীমাংসার জন্য বড়ই আটা গ্রামের তালুক-পরগনা সীমানায় গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। খেলার শর্ত ছিল- গুটি যাদের সীমানার দিকে বেশি নিয়ে গুম করতে পারবে, তারা হবেন তালুক। পরাজিত দল হবে পরগনা। সে সময় মুক্তাগাছার জমিদার বিজয়ী হন এবং তাদের আওতাভুক্ত স্থানকে তালুক নামকরণ করা হয়। তবে হার-জিৎ থাকলেও খেলা থেকে জনমনে যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছ, তা কিন্তু থেমে থাকেনি। আজও তা ধারণ করে আসছে সেখানকার মানুষ।
খেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয় বাংলা সাল হিসেব করে। পৌষের শেষদিন খেলার নির্ধারিত তারিখ। উপজেলার লক্ষ্মীপুর, বড়ই আটা, বাটিপাড়া, বালাশ্বর, চরকালিবাজাইল, তেলিগ্রাম, সাড়ুটিয়া, ইচাইল, কাতলাসেনসহ অন্তত ১৫-২০টি গ্রামের মানুষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। ঘরে ঘরে চলে নতুন আমন ধানের পিঠা-পুলির উৎসব। পিঠার মধ্যে অন্যতম নুন-মরিচের পিঠা, গুটা পিঠা, তেলের পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, কলার পিঠা। গ্রামগুলোতে খেলার কয়েকদিন আগেই আসতে থাকে দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন।
শুরু থেকে খেলাটি দুটি দল নিয়ে হলেও এখন চার দলে অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শুরু থেকে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম হিসেবে চারটি দল করা হয়। খেলা শুরুর নির্দিষ্ট সময় বিকেল চারটা হলেও জোহরের সময় থেকেই ছুটে আসতে থাকে দর্শনার্থীরা।
পিতলের তৈরি কমলালেবুর মতো বস্তুটির ওজন আনুমানিক ২০-২৫ কেজি। বিকেল চারটার আগেই গুটি উপস্থিত করা হয়। পিতলের বস্তুটিকে মাঝখানে রেখে চারদিক থেকে আসা খেলোয়াড়রা পর্যায়ক্রমে খেলতে থাকে। অনেকটা কেড়ে নেওয়ার মতো। তবে এই কাড়াকাড়ি হয় লক্ষ মানুষের ভিড়ে চেনা-অচেনা মানুষের মাঝে। এ জন্য কোনো খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট কোনো দল থেকে পুরস্কৃত করা হয় না। যার যার অবস্থান থেকে স্বেচ্ছায় খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
তবে খেলাতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তা হচ্ছে, জন্মভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। কারণ যারা অংশগ্রহণ করে তাদের মাঝে এই বোধটা কাজ করে যে, আমার দিকটাকে জেতাতে হবে। গুটিটি যেদিকে এসে গুম হবে সে বছর সে দিকের মানুষই বিজয়ী হবে। খেলা শেষে সবার মুখে একই কথা শোনা যায়, গুটি কোন দিকে গেল? খেলা শুরু হওয়ার পর সময়সীমা বাঁধা থাকে না। কোনো কোনো বছর সারা রাত খেলা চলে। এটি খেলতে হয় গায়ের শক্তি দিয়ে। তাই দুর্বল বা শিশুরা অংশগ্রহণ করতে পারে না।
খেলা চলার সময় প্রতিটি দিক থেকে একটি করে বিশেষ নিশানা থাকে। তাতে খেলোয়াড়রা সহজেই তাদের দিক চিনতে পারে। সে অনুযায়ী গুটিকে সেদিকে ঠেলে নেওয়ার চেষ্টা করে। খেলোয়াড়দের মনকে উৎফুল্ল রাখার জন্য ঢোল, সানাইয়ের ব্যবস্থা থাকে। বাদ্যের তালে তালে একসঙ্গে জড়ো হয়ে হাততালি দিতে দিতে সবার মধ্যে একজন ডাক ভাঙে, ‘জিতই আমাদের রে... (সবাই একস্বরে ডিও...)/ গুডি... নিলো... গা... রে... (সবাই একস্বরে ডিও...)’ বলতে বলতে গুটির ওপড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয় ততক্ষণ ঠেলতে থাকে। এভাবে ঠেলতে ঠেলতে সে দলটি বেরিয়ে আসে। আবার অন্যদল একইভাবে আবার বেরিয়ে আসে। প্রত্যেক দিক থেকে এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা চলতে থাকে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরা লোক খেলাটিকে উপভোগ করতে থাকে।
খেলতে খেলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলে খেলার পরিবেশ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইচাইল বিলের পাশের একটি বন্দে খেলা আরম্ভ হয়। কোনো কোনো সময় সেই বিলের মাঝখানেও চলে যায় খেলাটি। কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। খেলা দেখতে আসা হাজার হাজার মানুষ টর্চ লাইট নিয়ে আসে। খেলাকে ঘিরে নিজ নিজ দিকের লোকেরা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। দলকে সাহায্য করার জন্য টর্চ লাইট জ্বালিয়ে হাত নেড়ে ইশারা করতে থাকে। খেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ থাকে না। ফাঁকা জায়গার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। কখনো কখনো বিপদের মুখেও পড়তে হয়। ঝোঁপ-ঝাঁড় উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
দর্শকরা সবচেয়ে বেশি মজা উপভোগ করে যখন গুটিটি কোনো পুকুর বা খালে গিয়ে পড়ে। অমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গুটির ওপর। পৌষের শীতের রাতে কেউ একবারও ভাবে না, পরে কী হবে? অল্প পানি হলে চেষ্টা করা হয় গুটিকে কাঁদার নিচে লুকিয়ে ফেলার। কিন্তু ক’জনের চোখকে ফাঁকি দেবে? লুকালেও কোনো লাভ হয় না। এছাড়া ঠেলতে ঠেলতে যখন কোনো রাস্তার ধারে নিয়ে যাওয়া হয়; তখন প্রাণপণে চেষ্টা করা হয় রাস্তা পার করে নিয়ে যেতে। সে সুযোগটি হাতছাড়া করে না প্রতিপক্ষ। যখন গুটিকে ঠেলে উঠাতে চায়; তখন উপর থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেওয়া হয়।
এভাবে বিভিন্ন কৌশলে চলতে থাকে খেলা। বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত শেষ হয় না হুমগুটি খেলা। ফুলবাড়িয়ার এ ঐতিহ্যবাহী খেলা দেখার জন্য ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে অসংখ্য মানুষ।
লেখক: শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ।
এসইউ/আইআই