ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

পথ শিশুদের খুশির ঈদে ব্যথার অশ্রু

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২৫

ড.ফোরকান আলী

ঈদুল ফিতর সবার ঘরে বয়ে আনে আনন্দ। তবে পথ শিশুদের জীবনে কোনো খুশির বার্তা নিয়ে আসে না। দেশের প্রায় সব পথ শিশুর জীবনে এই দিনটি কাটে অন্যের মুখের পানে চেয়ে, তাদের করুণার পাত্র হয়ে। ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা’ তাদের আবার ঈদ কিসের!

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ঈদের আর মাত্র কয়দিন বাকি। ওরা আশায় বুক বেঁধে আছে। এই কয়দিনে বেচাবিক্রি একটু ভালো হলে সেই পয়সায় একটি নতুন জামা হয়তো কেনা যাবে! নয়তো কেউ তাদের জামা দিতে আসবে। যা পরে ওরা ঈদের দিন একটু ঘুরে বেড়াবে। ঈদের দিনে অন্য আর দশটা শিশুর মতো ফিরনী, সেমাই খাবার বায়না নেই ওদের। ওরা অন্যসব দিনের মতোই রোজগারের আশায় ফুল, চকলেট বিক্রি করতে নামবে পথে; নয়তো বোতল টোকাবে। ঈদের দিনে পথশিশুদের আশা করে থাকতে হয়, কখন তাদের কেউ ডেকে একটু সেমাই কিংবা পোলাও খেতে দেবে। মায়ের হাতের খাবার তাদের ভাগ্যে জোটে না।

পথশিশুদের জীবনে ঈদ কখনো খুশির ঈদ হয়ে আসবে না। তবুও তারা স্বপ্ন দেখে; আশায় বুক বাঁধে, হয়তো কোন হৃদয়বান ব্যক্তি তাদের জন্যে একদিন জামা-জুতা, ভালো খাবার নিয়ে আসবে! দারিদ্র্য আর না পাওয়ার মাঝে বেড়ে ওঠা ওদের জীবনে একটুখানি পাওয়াই অসীম আনন্দ বয়ে আনে। তবে ঈদের নতুন জামা বা ভালো খাবার খেতে না পারার জন্যে ওদের মনে কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ এটাই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে ওরা। ওরা জেনে গিয়েছে, কেউ খাবার জন্যে দিনভর কাজ করবে আর কেউ খাবার নষ্ট করবে। এটাই পৃথিবী।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আশার কথা, সঠিক পরিচর্যায় পথশিশুরাও হবে দেশের সম্পদ। বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করাটাও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এদের মধ্যে যারা রাস্তায় জীবনযাপন করে তারা পরিচিতি পায় পথশিশু হিসেবে। পথশিশুদের বেড়ে ওঠার মধ্যে তারা পরিচিত হয় নতুন অনেক অভিজ্ঞতার সঙ্গে। আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব পথশিশু সাধারণত রাস্তার জিনিসপত্র কুড়িয়ে বেঁচে থাকে। বেশিরভাগ পথশিশুর মা-বাবা নেই। অনেক সময় তাদের মা-বাবা থাকলেও তাদের পরিচয় পাওয়া যায় না।

আবার অনেকের মা-বাবা আছে কিন্তু যোগাযোগ নেই। তাদের জন্ম রাস্তায়, রাস্তায় তাদের জীবন কাটে এবং অবশেষে রাস্তায় তাদের মৃত্যু হয়। এসব শিশু সাধারণত দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, পরিবার থেকে পলায়ন ও যৌন নিপীড়নের কারণে রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হয়। কেউ তাদের দেখাশোনা করে না। শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন। এসব পথশিশুর না আছে কোনো পরিবার, না আছে কোনো স্বপ্ন। তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী। তারপরও তারা বেঁচে আছে। পথশিশুদের একদিকে অভাবের তাড়না অন্যদিকে অভিভাবকহীন। এই সুযোগে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে, জড়িয়ে পড়ছে নেশার জগতে।

বিজ্ঞাপন

রাস্তার পাশে গ্লুটারগাম বা আঠা দিয়ে প্রকাশ্যে ডেন্ডি নামের নেশায় আসক্ত তারা। ক্ষতিকারক ডেন্ডি এক ভয়ংকর নেশা। তৃণমূল অসহায় পথশিশুরা ছোট নেশার জগৎ থেকে হয়ে উঠছে নেশার জগতের মাফিয়া। করছে অপরাধ, গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। পথশিশু থেকে ডেন্ডি খোর তারপর কিশোর গ্যাং এরপর হয়ে ওঠে অন্ধকার জগতের রাজা। কখনো মাদক, কখনো অস্ত্র হাতে তুলতে দেখা যায় তাদের। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা, থাকার কথা পরিবারের বন্ধনে, সে বয়সে কেউ কেউ কাঁধে তুলে নিচ্ছে প্লাস্টিকের বস্তা আবার কেউবা হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। সমাজের আর ১০টা সাধারণ শিশুর মতো তাদের জীবন নয়।

বাংলাদেশে যত পথশিশু বসবাস করছে এবং এদের ৭৫ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে। যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সেখানে এই শিশুরা সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, আর পথশিশুর সংখ্যা ও বেড়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার।

পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার তথ্যমতে, পথশিশুদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। এছাড়াও অপরাধীচক্রগুলো এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। এরা আসলে অপরাধী নয়। এরা অপরাধের শিকার হয়।

বিজ্ঞাপন

সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। সামাজিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত-উপেক্ষিত এসব শিশুর পথে পথে ঘুরতে হয় কাজের সন্ধানে। পেটের দায়ে দিনমজুরি, বাসের হেলপারি, কারখানা শ্রমিকের কাজ, রিকশা চালানো, চা-সিগারেট বিক্রি, টোকাইয়ের কাজ, ইট ভাঙা কত কাজই না এরা করে। আসলে এই পথশিশুদের জীবনযাপন অনেক জটিল। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিও বেছে নেয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে তারা নানা জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ দায়ী। ক্ষুধার জ্বালায় এরা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার খেতেও দ্বিধাবোধ করে না। পথশিশুদের ক্ষুধার যন্ত্রণা আর সংজ্ঞা তাদের থেকে আর কারো বেশি জানা নেই।

পাশাপাশি নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এদের মধ্যে চর্মরোগের হারও অনেক বেশি। পথশিশুদের প্রায় ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলক বেশি। দেশজুড়ে সেমিনার, সভা-সমাবেশ, পথযাত্রা, ওয়ার্কশপ করে দেখানো হয় যে, শিশুদের জন্য অনেক কিছু করা হচ্ছে। তাদের আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি বিষয়ে যথোপযুক্ত নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায়। কিন্তু পথশিশুদের বেলায় তার কানাকড়িও করা হয় না। পথশিশুরা বাবা-মায়ের আদর-সোহাগ থেকে তারা বঞ্চিত। আদর-সোহাগ কী তারা জানে না। জীবনের প্রতি তাদের মায়া না থাকায় তারা বিপথগামী হয়ে উঠছে। সমাজে বাবা-মায়ের আদরের অন্যান্য সন্তানের মতো শিশুদের যে সময় স্কুলে যাওয়ার কথা, সে সময়ে তারা অনাদর ও অবহেলায় রাস্তায়, ফুটপাথে, স্টেশনে, পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা একসময় হয়ে ওঠে অপরাধী। আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এই শিশুরাও সমাজের সম্পদ। তাদের যথাযথ আদর-ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপালন করলে তারা সমাজে বিদ্বেষী না হয়ে সমাজের বন্ধু হতে পারে।

ঢাকাসহ সারাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব উপেক্ষিত পথশিশুর যথাযথ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব শিশুরও অধিকার রয়েছে আট-দশটা সাধারণ শিশুর মতো বেড়ে ওঠার। উপযুক্ত পুনর্বাসন, শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার পেলে তারাও হয়ে উঠবে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, সমাজসেবক ইত্যাদি। এতে এসব পথশিশুর জীবনপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রও লাভবান হবে। ঢাকাসহ সারাদেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক বেসরকারি সংগঠন কাজ করে। কেউ খাবার দেয়, কেউ পোশাক দেয়, কেউ দেয় শিক্ষা, কেউ আবার তাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করে। কিন্তু দিন শেষে তাদের পথেই ফিরে যেতে হয়। পথশিশুদের নিয়ে শহরে অনেক বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে। সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়। তাদের দরকার স্থায়ী থাকার জায়গা, শিক্ষা এবং খাবারের ব্যবস্থা। তাদের অন্যান্য শিশুর মতো জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আজকের শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার। তাই পথশিশুর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। পথশিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া কখনও ঠিক হবে না। প্রতিটি শিশুর মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা। তেমনিভাবে সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের ভেতরও রয়েছে আলাদা একটি জগৎ। তাদের চিন্তাধারাও আলাদা আলাদা। ওদেরও স্বপ্ন আছে। আজকে যে শিশুটি হেসে-খেলে বড় হচ্ছে কাল সেই হবে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতির অভিভাবক। তাই তো কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে।’ সুতরাং এই দেশ ও জাতির মঙ্গলের কথা মাথায় রেখেই আমাদের শিশুদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হবে প্রত্যেকটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। তাদের প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের নীতিবান, সৎ, কর্মদক্ষ সচেতন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা আশাকরি এই ঈদে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এদের রাষ্ট্রের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

কেএসকে/এএসএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন