শাকিবের ‘দরদ’: নির্মাণে প্রয়োজন ছিল বাড়তি দরদ
‘অটোগ্রাফ’ দিয়ে জন্ম হয়েছিল নতুন এক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। সেরকম ‘দরদ’ দিয়ে জন্ম নেওয়ার কথা ছিল নতুন এক শাকিব খানের। অন্তত ছবির ট্রেলার দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। কিন্তু হায়, দুর্ভাগ্য, কোথায় যেন খামতি রেখেই শেষ হয়ে গেল সিনেমাটি। নির্মাণে কোথায় যেন একটু দরদের অভাব রয়ে গেছে!
আশার কথা হলো শাকিব খানের সুযোগ ফুরায়নি। নবজন্মের প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। ‘তুফান’ তার সাক্ষ্য দেবে। এরপর ‘দরদ’ এক অন্য রকম গল্পের সিনেমা হিসেবে ঢুকে পড়েছে ওই নবযাত্রার তালিকায়। ছবিতে শাকিব খানের অভিনয়ও মনোমুগ্ধকর। বলা চলে, পুরো সিনেমা একাই টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। তবে সিনেমা দেখে মনে হতে পারে, কোথায় যেন একটু তাড়াহুড়ো ছিল নির্মাতার।
‘দরদ’ দ্বিধায় ফেলে দেবে দর্শককে। দেশি প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানা হিসেবে নতুন। সিনেমা শুরু হয় ডাক্তার বংশীধর হত্যাকাণ্ড দিয়ে। কিন্তু হত্যাটা যে দুলু মিয়াই করেছেন, তা বুঝতে বাকি থাকে না দর্শকের। পাশের দর্শক বারবার বলছিলেন, ‘এটা শাকিবের এ্যান্ট্রি শট, কিন্তু হাইওয়ের নয়েজের কারণে সেটা ভালো লাগলো না।’ পরের দৃশ্যেই একত্রে দেখা যায় দুলু মিয়া ও ফাতেমাকে, প্রধান দুই চরিত্র, শাকিব খান ও বলিউড অভিনেত্রী সোনাল চৌহান।
গল্প সংক্ষেপ
ফাতেমার জীবন উদ্দীপ্ত করে রেখেছে সিনেমার নায়ক সরফরাজ খান। ছোটবেলা থেকে তার সিনেমা দেখে বড় হয়েছে সে। স্বামী দুলু মিয়ার মধ্যেও সে পর্দার সরফরাজের সব বৈশিষ্ট্য দেখতে চায়। স্বামীর কাছে আবদার করে, জীবনে একবার হলেও সরফরাজকে সামনাসামনি দেখার। সরফরাজের শুটিংয়ে যাওয়া, বউয়ের হাতে বানানো মিষ্টি খাওয়া, দুর্ঘটনাজনিত খুন ও সেই খুনীকে খুঁজে বের করার তদন্ত ঘিরে গল্প।
বউয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য হাজারটা খুন করতে পারে দুলু মিয়া। কিন্তু যে সরফরাজ তার বউয়ের ভালোবাসা, আবেগ কিংবা আনন্দের কারণ, তাকে কেন খুন করবে অটোচালক দুলু? সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সিনেমাও গড়ায় মন খারাপের দিকে। তবে রহস্যটা অনুমিত। আগে থেকে জেনে গেলে কি আর শেষ পর্যন্ত দেখার অপেক্ষা ভালো লাগবে?
অভিনয়
ছবিতে সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছেন শাকিব খান। সেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘দুলু মিয়া’। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে মুহূর্তের মধ্যে অভিব্যক্তি পরিবর্তনে কারিশমা দেখিয়েছেন শাকিব। বলা বাহুল্য, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিনেতা হিসেবে শাকিব খান অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছেন।
ফাতেমা চরিত্রে সোনালের অভিনয়ও ছিল চরিত্রাভিনেতার মতোই। দুলু-ফাতেমার সংসার জীবনের খুনসুটি, তাদের রসায়ন দেখে মনে হয়নি, এটি এ জুটির প্রথম সিনেমা। তবে কানে লেগেছে সোনালের সংলাপ বলা। বাংলায় তার কথা বলা কিছুটা খাপছাড়া মনে হচ্ছিল।
সুপারস্টার সরফরাজ চরিত্রে রাহুল দেব ছিলেন দারুণ বাছাই। তবে অভিনেত্রী তৃণা চরিত্রে সাফা মারুয়াকে তেমন যুৎসই লাগেনি। সেখানে বরং পায়েলকে কল্পনা করে ভালো মনে হচ্ছিল। অন্যদিকে অন্তসত্বা চরিত্রে পায়েলকে দেখতে যুৎসই লাগেনি। আবার পুলিশ অফিসার চরিত্রে ঠিক কী কারণে তাকে দেখানো হলো তাও বোধগম্য হয়নি। সন্তানসম্ভবা একজন নারী কেন এ রকম খুনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পেলেন? মনে হয়েছে, এটা কি হলিউডের কোনো সিনেমার অনুকরণ? কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে একজন নারীর মাতৃত্ব যে কোনো দায়িত্বের চেয়ে গুরুদায়িত্ব! সংবেদনশীলতার নিরিখে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে চরিত্রটি।
তৃণার সহকারী আকাশ চরিত্রটা মানানসই হলেও বন্যা চরিত্রে এলিনা শাম্মীকে মানায়নি। তবে তিনি মন্দ করেননি। ভারতীয় পুলিশ হিসেবে তাকে বেশ সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাদবাকি চরিত্রগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুব কম।
দৃশ্য ও গান
সিনেমার গানগুলো নিয়ে চাইলেই অভিযোগ তোলা যায়। ‘লুট করেছো’ কিংবা ‘এই ভাসাও’ গানের সঙ্গে লিপসিং মেলেনি। তবে শেষদিকে মন খারাপের দৃশ্যে ইমরান মাহমুদুলের কণ্ঠে ‘এক প্রেম’ গানটি শ্রুতিমধুর ছিল। এ ছাড়া সিনেমার পোস্ট ক্রেডিট দৃশ্যে নোবেলের ‘ওরে পাগল মন’ গানটাও ছিল এনার্জেটিক।
গানসহ পুরো সিনেমার অধিকাংশ দৃশ্যের শুটিং ভারতের বেনারসের আশপাশেই হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তাই দৃশ্যগুলো চোখের জন্য আরামদায়ক ছিল। এমনকি আবহসংগীতের জন্য প্রশংসা পেতে পারেন পরিচালক অনন্য মামুন।
‘দরদ’কে শাকিবের ক্যারিয়ারের অন্যতম সমৃদ্ধ অভিনয়ের সিনেমা হিসেবে সংযুক্ত করা যেতেই পারে। এ রকম গল্পের, বাজেটের, কাস্টিংয়ের সিনেমায় একটু বাড়তি দরদের বড্ড প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে দর্শক ও চলচ্চিত্র অনুরাগী হিসেবে প্রত্যাশা, আরও চৌকশ নির্মাতার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাক শাকিব খান।
এমআই/আরএমডি/জিকেএস