শতাধিক শ্রমিক উপভোগ করলেন ‘জুলেখার জীবন’
ছোট্ট ঘরে বসবাস। নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা। রান্নাঘরে গ্যাস আসে না ঠিকমতো। সাথে একজন প্রতিবন্ধী সন্তান, যার পরিচর্যায় মায়ের ধৈর্য্যের পরীক্ষা চলে প্রতিনিয়ত। এমনই এক অসহায় মায়ের নাম জুলেখা, যিনি প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন নতুন উদ্যমে।
শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় পয়সার জন্য তাকে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয়, আর মুখোমুখি হতে হয় অসংখ্য ইভটিজিং, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। এইসব কষ্টই উঠে এলো ‘জুলেখার জীবন’ নাটকে, যা গাজীপুরে আয়োজিত এক নাট্য প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়। ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে পরিচালিত ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে এই নাটকটি প্রদর্শিত হয়।
এই প্রদর্শনীতে প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক উপভোগ করলেন তাদেরই জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেনো কেউ তাদের জন্য নীরব কান্নার গল্প লিখে দিয়েছে। নাটকের প্রতিটি মুহূর্তে যেনো শ্রমিকদের জীবনের কষ্ট ফুটে উঠল, সমাজের প্রতি তাদের ক্ষোভ যেন গর্জে উঠল এক নীরব আক্রোশের সুরে। তাদের জীবন কেবল দৈন্যদশায় ভরা নয়, বরং তা হলো বাস্তবের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি, যা দেশের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক প্রতিদিন নিজের শরীরের ঘাম দিয়ে গড়ে তোলে। কিন্তু তার বিনিময়ে কী পায়? এক নিরাশার জীবন।
এই করুণ কাহিনী শুধুমাত্র গাজীপুরের শ্রমিকদের জন্য নয়, বরং এই অবস্থা যেন গোটা দেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের এক অমোঘ নিয়তি। তাদের জীবনে হাসি যেন নিষ্প্রাণ, তাদের চোখে সাফল্যের স্বপ্ন নয়, বরং জীবনযুদ্ধের এক দীর্ঘশ্বাস।
বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীদের জন্য ডে-কেয়ারের সুবিধা খুবই সীমিত। দেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে মোট ডে-কেয়ার কেন্দ্রের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বর্তমানে মাত্র ১১৯টি সরকারি ডে-কেয়ার কেন্দ্র রয়েছে, যার বেশিরভাগই ঢাকা শহরে অবস্থিত। দেশের বেশিরভাগ জেলায়, বিশেষ করে ৩৬টি জেলায়, কোনো ডে-কেয়ার কেন্দ্রই নেই, যা কর্মজীবী নারীদের জন্য বিশাল এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এই সীমাবদ্ধতা থেকে অনেক নারী কর্মজীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন, বিশেষত সন্তান হওয়ার পর চাকরি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শিশুদের জন্য ডে-কেয়ারের অভাবের কারণে মায়ের মনের অস্থিরতা দিন দিন বেড়ে চলে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত গার্মেন্টস কর্মী নার্গিস তার বাস্তব জীবনের কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আগে আমার মা আমার ছোট মেয়েকে দেখে রাখতো। এখন মায়ের মৃত্যুর পর মেয়েকে একা বাসায় রেখে আসতে হয়। অফিসে ডে-কেয়ার না থাকায় সারাদিন শুধু চিন্তায় থাকি।’
এই কর্মসূচিতে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ম্যানেজার আরাফাত আলী সিদ্দিকী বললেন, ‘সরকার আসে, পরিবর্তন হয়, কিন্তু নাগরিক অধিকার আর সমস্যার সমাধান হয় না। শ্রমিকরাও নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। amiojittechai.com প্ল্যাটফর্মে এখন নাগরিকরা নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরতে পারবেন। সেগুলোর সমাধানে কাজ করতে চাই আমরা।’
তিনি জানান, ইউএসএআইডির স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্পের আওতায় এই ক্যাম্পেইন দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়ে শ্রমিকদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তার মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে নিজেদের অধিকারের কথা বলতে পারছে, তা তাদের জীবনের জন্য এক নীরব বিপ্লব।
‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন জেলা ও ক্যাম্পাসে নাট্য প্রদর্শনী, কর্মশালা ও আলোচনার আয়োজন করে থাকে। এভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা শুনে তাদের প্রতি সমাজের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আয়োজকরা মনে করেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ তাদের অধিকার এবং দাবি নিয়ে একযোগে কথা বলতে পারবেন, এবং এতে করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রভাবিত হবে।
এলএ/জিকেএস