‘আপা তুই রাগ করে থাকিস না আর’ গানটি মনে পড়ে
‘আপা তুই রাগ করে থাকিস না আর / অপদার্থ বলে ডাকিস না আর’ গানটি আজ বড্ড মনে পড়ছে। রাগ করে ‘আপা’ গিয়ে শুয়ে ছিলেন রান্নাঘরে। তার মান ভাঙাতে সপরিবারে গানটি গাইছিল ছোট দুই ভাই ও তাদের দুলাভাই, আলীরাজ, সালমান শাহ ও বুলবুল আহমেদ। মালেক আফসারি পরিচালিত ‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমার ‘রাগ করে থাকিস না’ গানটি মনে পড়ার দুই কারণ। এক, আজ নায়ক সালমান শাহর ৫৪তম জন্মদিন। দুই, গত ৬ তারিখ ছিল তার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ দুই তারিখের মাঝে ভাইরাল হলো এক বেদনার্ত ছোট ভাইয়ের আপা-আপা বলতে থাকা আন্তরিক ফোনালাপ।
ওই গানে দেখা গেছে হাস্যোজ্জ্বল চরিত্রের এক ছোট ভাই সালমানকে। কি হৃদয়বিদারক পরিণতি হয়েছিল ‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমায় দেখানো সংসারটির, যারা দেখেছেন, বোধকরি আজও ভুলতে পারেননি। এই সিনেমার ভেতর দিয়ে যদি প্রবেশ করা যায় সালমান শাহর অভিনয় করা সিনেমাঘরে, পাওয়া যাবে মাত্র ২৭টি সিনেমা। মাত্র ২৫ বছরের তরুণ, ২৭টি সিনেমা করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। যেন বলে গেছেন, ‘আমারে দেব না ভুলিতে।’ আজও মানুষ তাকে মনে রেখেছে। আজও তার জন্য মানুষের ভালোবাসা অফুরান। আজও তাকে নিয়ে মানুষ কথা বলে। অথচ তার নামে শহরে নেই কোনো সড়ক, কোথাও নেই তার ভাস্কর্য, তার নামে নামকরণ করা হয়নি কোনো স্থাপনা, মিলনায়তন বা চলচ্চিত্র জাদুঘরের কর্নার! সালমান আছেন, হৃদয়ে হৃদয়ে।
নতুন প্রজন্ম, জেনারেশন জেড সালমানের নাম শুনেছে। ইউটিউবে হয়তো তার সিনেমাও দেখেছে কেউ কেউ। গুগলের এই যুগে তাকে নিয়ে জানার কিছু বাকি নেই বোধকরি। তবু বছর বছর জন্মদিন এলে সেই পুরাতন অ্যালবামের মতো খুলে দেখতে ইচ্ছে করে সালমান শাহ নামের স্মৃতির অ্যালবামটিকে। মনে করতে ইচ্ছে করে তার অভিনীত সিনেমাগুলো কীভাবে জাগিয়েছিল প্রেমানুভূতি, কীভাবে ভিজিয়েছিল চোখ, কোনটি গান, কোন সংলাপ, কোন মুহূর্তটি উদ্দীপ্ত করেছিল! লেখা বাহুল্য, তার সিনেমাগুলোর প্রাণ ছিল গান। মূলত গানগুলোতে তার অভিব্যক্তি ওই গানগুলোকে অমর করেছে।
একটা রিমেক সিনেমা দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল সালমান শাহর। বলিউডের ১৯৮৮ সালের ‘কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক’ থেকে ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান বানিয়েছিলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি। এখন যেমন ‘আদর করে’ বাংলাদেশের সিনেমাকে অনেকে ঢালিউড লিখি, তখন সেটা লেখা বা বলা হতো না। তবু তখনকার ওই রিমেক সিনেমাটি এলোমেলো করে দিয়েছিল দর্শকের হৃদয়। নতুন হিরো, নতুন হিরোইন, বলিউডের গল্প অথচ অভিনয় আর বাংলা ভাষায় গল্পটি দেখার অভিজ্ঞতা আজকের ঢালিউডের সিনেমা থেকেও ছিল মূল্যবান। নায়িকা মৌসুমী ও নায়ক সালমান শাহকে মূল্যবান রত্নের মতোই ব্যবহার করেছিলেন তখনকার এফডিসির ডিরেক্টররা। সালমানের অভিনয়ের জন্য সেরা গল্প, তার ঠোঁটের শোভা বাড়াতে সেরা গীতিকবিতা, সেরা সুরকারের করা গান, সব আয়োজনকে একত্র করে বানানো হয়েছিল সিনেমা। সেগুলো আজও, দরিদ্র হলেও, সমৃদ্ধশালী বাংলা ছবির গুরুত্বপূর্ণ নজির।
সালমান শাহর জন্ম সিলেটের দাড়িয়াপাড়ায়। বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা নীলা চৌধুরী করতেন রাজনীতি। একাধিকবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করেছিলেন। সালমানের একমাত্র ছোট ভাই চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরান (ইভান)। সালমান পড়াশোনা করেছেন খুলনার বয়রা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। একই স্কুলে তার প্রথম ছবির নায়িকা মৌসুমীও তার সহপাঠী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমণ্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি ও ধানমণ্ডির ড. মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন। ১৯৯২ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরা তখন বিউটি পার্লার চালাতেন। সালমানের দুটি সিনেমার পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। সিনেমার স্টাইল ও ফ্যাশন বিষয়ে তার কাছ থেকে পরামর্শও নিতেন সালমান। প্রচার আছে, স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করেই আত্মহত্যা করেছিলেন সালমান। যদিও ভক্তরা সেটা আজও বিশ্বাস করেন না। কারণ মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে মৃত্যু প্রসঙ্গে সালমান বলেছিলেন, ‘এখনই এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত নই। শুধু আমার নয়, কারও ভাগ্যে যেন বিধাতা অকাল মৃত্যু না লেখেন।’
সালমানের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছিল দেশ ও বিদেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তার মৃত্যু-সংবাদে লিখেছিল, সালমান শাহ ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা তারকা। লিখেছিল, মাত্র ২৫ বছর বয়সী একজন অভিনেতার মৃত্যুতে সারা দেশ শোকে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কয়েকজন তরুণীর আত্মহত্যার কথাও শোনা গিয়েছিল সে সময়। নায়ক হিসেবে তখন তাকে ‘নাম্বার ওয়ান’ তকমা দিতে হয়নি। অথচ আজও, ভালোবাসার অন্য নাম সালমান।
আরএমডি/এএসএম