চলচ্চিত্রের অভিনয় ও গানে অনন্য কাজী নজরুল ইসলাম
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য রূপকার। তিনি বিদ্রোহী, তিনিই গানের পাখি বুলবুল। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। যিনি এসেছিলেন জ্যৈষ্ঠে, বিদায় নিয়েছেন ভাদ্রে। আজ ১২ ভাদ্র তার ৪৮তম প্রয়াণ দিবস।
এদিনে কবিকে স্মরণ করা হচ্ছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। তার সৃষ্টি নিয়ে হবে আলোচনা ও নানামাত্রিক চর্চা।
অমর সব সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি কাজী নজরুলকে পাওয়া যায় একজন চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবেও। চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং গানও গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন কবি নজরুল।
১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। পুরাণের কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হয়। নজরুল এ ছবির গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয়ও করেন এবং একটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি ‘ধ্রুব’ মুক্তি পায়।
তবে চলচ্চিত্রে তার যুক্ত হওয়া ১৯৩০-৩১ সালে ম্যাডান থিয়েটার্স প্রথম বাংলা সবাক ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এ ছবি নির্মাণের উদ্যোগে কাজী নজরুল যুক্ত হন ‘সুরভাণ্ডারি’ হিসেবে। তার দায়িত্ব ছিলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করা
জানা যায়, ত্রিশের দশকে নজরুল পার্শি মালিকানাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটার্সের ‘সুর ভাণ্ডারী’ পদে নিযুক্ত হন। এই পদটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে শিল্পীরা সিনেমায় গাইবেন তাদের গান শেখানো এবং যে অভিনেতা ও শিল্পী অভিনয় করবেন ও গাইবেন তাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর দায়িত্ব পালন করেছেন নজরুল।
১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’তে সুর ভান্ডারীর কাজ করেন নজরুল। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরও যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুল সম্পৃক্ত ছিলেন সেগুলো হল, ‘জ্যোৎস্নার রাত’ (১৯৩১), ‘প্রহল্লাদ’ (১৯৩১), ‘ঋষির প্রেম’(১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘চিরকুমারী’ (১৯৩২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’(১৯৩২), ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’(১৯৩২), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৩৩) এবং ‘জয়দেব’(১৯৩৩)।
১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জলসা’ ছবিতে নজরুল তার নারী কবিতার আবৃত্তি ও একটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩৩ সালে ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিতে গীতিকার হিসেবে যুক্ত হন এই সাম্যের কবি।
১৯৩৪ সাল সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ধ্রুব’ পরিচালনা করেন তিনি। এতে অভিনয়ও করেছিরেন নারদের চরিত্রে। ছবির গীতিকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গান ছিলো নজরুলের লেখা। তিনি নিজে কণ্ঠও দেন এ ছবির ৩টি গানে।
১৯৩৫ সাল ‘পাতালপুরী’ ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। ১৯৩৭ সালে সংগীত পরিচালনা করেন ‘গ্রহের ফের’ সিনেমায়। ১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্যাপতি’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন এতে রবীন্দ্রনাথের গানে সুরারোপ করেন নজরুল।
১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এ সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘সাপেড়া’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও হয়েছিল। তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল।
‘রজত জয়ন্তী’(১৯৩৯), ‘নন্দিনী’ (১৯৪১), ‘অভিনয়’ (১৯৪১), ‘দিকশূল’(১৯৪১) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গান লিখেছিলেন নজরুল। তার গানগুলো সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত।
১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি।
‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) ছবির গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ সিনেমার গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে নির্মিত হলে সে ছবির জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন তিনি।
১৯৪১ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম,সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ।
১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। মস্তিষ্কের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর বাকরুদ্ধ ছিলেন তিনি। সেই প্রতিষ্ঠানটির কাজ বেশিদূর এগোয়নি আর।
এইসব তথ্য প্রমাণ দেয় চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তনের দিকেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি।
এলএ/জিকেএস