মানুষের রক্তের ওপরে কোনো সরকার দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না
সরকারের নানান বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার অভিনেতা ও নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও সরব ছিলেন তিনি। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলেন তিনি। সরকার পতনের আগে ও পরের নানান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মইনুল ইসলাম।
জুলাই মাসটা কেমন কেটেছে আপনার?
উৎকণ্ঠা ও সম্ভাবনার অনুভূতির মধ্যদিয়ে কেটেছে। মানুষের মৃত্যু-ধ্বংস আমাকে ব্যথিত করেছে। তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে একটা অর্জন এসেছে। তাজা প্রাণগুলো গেছে, তার পরিবর্তে যে সরকারের পতন অবধারিত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। মানুষের রক্তের ওপরে কোনো সরকার দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মোটামুটি গণতান্ত্রিক দেশে সে রকমই প্রাকটিস আছে। আর বাঙালি জাতির মধ্যে বীরত্বের একটা ব্যাপারও আছে। সে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। বাঙালি জাতি তো আজ থেকে যুদ্ধ করছে না। আমি মনে করি সূর্যসেন মুক্তিযোদ্ধা। এই যে শৃঙ্খল ভাঙার প্রবণতা বাঙালির মধ্যে ভীষণভাবে আছে, জুলাই মাস ধরে আমরা সেটা আবারও দেখলাম। ছোট একটা বিষয় থেকে আস্তে আস্তে কেমন করে মহীরুহ আকার ধারণ করলো। রাষ্ট্র যখন গুলি চালালো, তখন পরিস্থিতিটা চলে গেল অন্যদিকে। জনগণের উত্থান হল। বিশেষ করে ছাত্র সমাজের বড় উত্থান হয়েছে। এমন নয় যে, কয়টা ছাত্র দাঁড়িয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন করলো। তারপর দেশে এমন ঘটনা ঘটে গেল, কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। এই আন্দোলনের সঙ্গে সংক্ষুব্ধ মানুষ যুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যে প্রাকটিসটা ছিল, সেটা একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচারের মতো। সেটাও টিকে যাচ্ছিল। মানুষ উন্নয়ন দেখছিল, তার ভেতরে সয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা চলে এসেছিল। কিন্তু যখন মানুষের বুকের রক্ত ঝরে, তখন সে আর নিতে পারে না।
প্রতিবাদ জানাতে আপনি পথে নেমেছিলেন। অনেকে নামেনি। আপনি এত সাহসী হতে পারলেন কীভাবে?
আমাদের প্রথম ব্যাপারটা ছিল মানুষের মৃত্যু, ছাত্রের মৃত্যু। রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এইটার প্রতিবাদে নেমেছি আমরা। এটা তো হতে পারে না। আমাদের মূল বিষয়টা ছিল মানুষকে হত্যা করা যাবে না। প্রতিবাদী হতে সাহস লাগে না। আন্দোলন যৌক্তিক হলে প্রতিবাদ হবেই। মাথার মধ্যে যদি যুক্তি কাজ করে, তাহলে প্রতিবাদ আপনা-আপনিই চলে আসে – এটা কি হচ্ছে! ওই বাচ্চাটা কেন মারা যাবে? কেন গুলি চালাতে হবে? তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এমনটা হবে। একে সাহস না বলে, আমার মতে বলতে হবে যুক্তিযুক্ত প্রকাশ। আর আন্দোলনমুখীতা তো আমাদের মধ্যে আছেই। এটাকে আমি সাহস বলতে চাই না। এটা এক ধরণের যৌক্তিক অবস্থা।
- আরও পড়ুন
- বেতার, শিল্পকলা, বিটিভিসহ কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হতো না
- নতুন দিনের পুলিশ প্রত্যাশা করেন ফারুকী
স্বৈরাচার পতনকে আমরা বলছি দ্বিতীয় ‘স্বাধীনতা’। শব্দটি কি শেষ পর্যন্ত আমাদের থাকবে?
দ্বিতীয় স্বাধীনতা শব্দটার সঙ্গে আমি একমত নই। এরশাদের পতনও তো একই রকম গণঅভ্যুত্থানে হয়েছিল। মানুষের মৃত্যুটা তখন কম হয়েছিল। আমরা কি সেটাকে স্বাধীনতা বলেছি? যদি বলি, তাহলে তো এটাকে বলতে হবে তৃতীয় স্বাধীনতা। আন্দোলন হলে কি তাকে স্বাধীনতা নাম দিতে হবে? আমরা তো জানি না, মাত্র তো ঘটনাটা ঘটেছে। তাহলে ১৯৭১ সাল কী? একটা দেশে তো দুইটা স্বাধীনতা হয় না। একে একটা সফল আন্দোলন বলা যেতে পারে।
সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিবেশও বেশ অরাজক হয়ে পড়েছে। সেখানে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
এটার বড় কারণ ওই একই। একটা লোককে দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর তার অবস্থান থেকে সরছে না। নেতৃত্ব দিতে পারছে না, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। এবং দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিকে নজর দিচ্ছে না। বরং পদপদবী আঁকড়ে ধরে আছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তার প্রতি আমাদের ঘৃণা জন্মেছে, তার জন্য আমাদের বারবার পথে নামতে হয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে হটাতে পারিনি। সরকারও এই ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি।
এখানে জরুরি ভিত্তিতে কী কী পরিবর্তন প্রয়োজন?
এই সরকারকে (অন্তর্বর্তী সরকার) চিনি খুব কম। আমাকে যদি বলা হয়, আমি তাদের কয়েকটা লোকের নামটাম জানি। তাদের কর্মকাণ্ড, যারা এখন চালাবে, এদের অতীতটা যদি বাদ দিয়ে দিই, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী এখন পর্যন্ত আমরা জানি না। তারা কি করতে পারে, না করতে পারে …। এখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের কোনো প্রতিনিধি নাই। এদের মধ্যে কেউ এই অঙ্গনেরও নয়। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই সুবুদ্ধির উদয় হবে যে, শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতি জরুরি জিনিস। এর একটা সুষ্ঠু ধারা থাকা উচিত।
আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালে তো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধি ছিলেন। তখন কি অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে?
অনেকে বলে আওয়ামী লীগের সময়ে অনেক কিছু অর্জন করেছে। আমি তো সেটা দেখছি না। দেশের কালচারে কিছুই অর্জিত হয়নি। বড় কিছু স্থাপিত হয়নি। আমাদের কিন্তু ফাইট করতে হয়েছে। কালচারে বড় পরির্বতন আসেনি। যাত্রাশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্র একে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। অনেক অঞ্চলের লোকজ ফর্ম খুঁজে পাওয়া যায় না। ধরা যাক টাঙ্গাইরের সঙ-এর কথা যদি বলি, কয়টা লোক আছে যারা সঙ ঠিকমতো করতে পারে? কয়টা লোক আছে যে এই কাজটাই করে খেতে পারবে? কিচ্ছা বলার লোক নাই। প্রতিটা ফর্মের ক্ষেত্রেই বলা চলে লোক নাই। ঢাকায় প্রথম পালা এসেছে ইসলাম উদ্দিন পালাকারের মাধ্যমে। তবে লোকে প্রথম চিনেছে কুদ্দুস বয়াতির মাধ্যমে। বাংলা একাডেমিতে প্রথম পালা দেখেছি, সাইদুর ভাই (সাইদুর রহমান বয়াতি) নিয়ে এসেছিলেন। পালার যে শক্তি, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু তা তো এখন আর নাই বললেই চলে। এই কাজগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা লাগে। এই মানুষগুলো মূলত কৃষক। অবসর সময়ে গান করেন। একসময় গান করতে করতে পালার দিকে চলে আসেন। কিন্তু এক সময় দেখে পালায় টাকা নেই। পরে তারা আর কৃষিতে ফিরে যেতে পারে না। সারা পৃথিবীতে এসব লোকজ ফর্ম বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্রের অনেকগুলো দায়িত্ব থাকে, যেমন হাসপাতাল চালানো, ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া। সেই রকম রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই লোকগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। বাংলাদেশ বললে কিন্তু মানুষের সামনে কোনো কিছু ভেসে ওঠে না। ইংল্যান্ড বললে পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে শেকস্পিয়র ভেসে ওঠেন। সে রকম ‘জাপান’ বললে, ‘চায়না’ বললে মানুষের চোখের সামনে কিছু একটা ভেসে উঠবে। চায়না, জাপান সেসব জিনিসকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
থিয়েটারকে কি গণমানুষের শিল্প করা গেছে?
আমি তো সেটাই বললাম। গণমানুষের শিল্প থিয়েটার। আমরা ঢাকা-চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে যে থিয়েটার করি, শহরকেন্দ্রীক যে থিয়েটার দেখি সেটা প্রসেনিয়াম হলের মধ্যে, এটাই একমাত্র থিয়েটার না। এর জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। আগেও ছিল, খুব বাজে অবস্থায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর কলকাতার নাট্যচর্চা দেখে এসে তরুণরা থিয়েটারের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে এক অদ্ভুত থিয়েটার। অথচ থিয়েটার সবসময়ই ছিল বাংলাদেশে। অনেক ফর্ম ছিল সেগুলোর। সেই থিয়েটার সংকুচিত হয়েছে পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে। এর জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদও কিছুটা দায়ী।
শিগগিরই নতুন কী প্রযোজনা আনছেন প্রাচ্যনাট থেকে? স্বৈরাচার পতনের ইস্যুটা কি কোনোভাবে সেখানে থাকবে?
প্রাচ্যনাট সবসময় নতুন নাটক নিয়ে আসে। গত দুই বছরে তিনটা নাটক করেছে। নতুন কাজ শুরু হবে সামনের মাসে। এই ইস্যু নিয়েও নাটক হতে পারে।
অনুদান, পুরস্কার, কাজ সবই চলে গিয়েছিল একটি গোষ্ঠীর হাতে, আপনি কি একমত? দীর্ঘদিন প্রবল দলীয়করণের মধ্যে থাকার পর সংস্কৃতি অঙ্গনকে নিয়মের মধ্যে আনা সম্ভব কীভাবে?
এটা রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। এটা যে শেখ হাসিনার আমলেই হয়েছে, তা নয়। এর আগের সরকারের আমলেও এসব হয়েছে, আমরা দেখেছি।
এমআই/আরএমডি/জিকেএস