বশির আহমেদকে মনে পড়ে
যখন দুঃসময় তাড়া করে মানুষ তখন সুখের দিনগুলোর কথা খুব ভাবে। সে ওই দিনগুলো থেকে সুখের স্মৃতি নিয়ে রোমাঞ্চিত হয়, অনুপ্রাণীত হয়। তেমনি আমাদের গানের এই দুঃসময়ে আমরাও স্মরণ করি গানের সোনালি অতীতকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই দিনগুলোতে যারা গানকে নান্দনিকতা দিয়েছিলেন; তাদের।
সেইসব মানুষদের মধ্যে অন্যতম কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ও গানের ওস্তাদ বশির আহমেদ। তার কণ্ঠে আমাদের গানের ভুবন ঐশ্বর্যবান হয়েছে। তার যত্ন আর মমতার লালনে আমরা পেয়েছি কনকচাঁপার মতো বরেণ্য কণ্ঠশিল্পীকে।
দেখতে দেখতে দুই বছর পূর্ণ হয়ে গেল বশির আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নিজের বাসভবনে ৭৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অসংখ্য কালজয়ী গানের এই গায়ক।
১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন বশির আহমেদ। ১৫ বছর বয়সেই উচাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। নিয়মিতই গেয়েছেন রেডিও-টেলিভিশনে। তবে তাকে জনপ্রিয়তা এনে দেয় চলচ্চিত্রের গানগুলো। চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে বশির আহমেদের কণ্ঠ পরশ পাথর হয়ে এসেছিলো। সেই পাথরের ছোঁয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে ‘সবাই আমায় প্রেমিক বলে’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’ ‘ডেকো না আমারে তুমি’, ‘ওগো প্রিয়তমা’, ‘খুঁজে খুঁজে জনম গেল’, ‘ঘুম শুধু ছিল দুটি নয়নে’, ‘যারে যাবি যদি যা’, ‘কাঁকন কার বাজে রুমঝুম’, ‘আমাকে যদি গো তুমি’ ‘ভালোবেসে এত জ্বালা কেন বলো না’- ইত্যাদি কালজয়ী গান।
বশির আহমেদ প্রথমে কলকাতায় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেনের কাছ থেকে সংগীত শিখেন। তারপর পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ’র কাছে তালিম নেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। তারপর থেকেই মূলত তার উত্থানের শুরু।
ষাটের দশকে চিত্রনির্মাতা মুস্তাফিজের ‘সাগর’ ছবির জন্য গান লেখার মধ্য দিয়ে রুপালি জগতে পা দিয়েছিলেন বশির আহমেদ, সেই সঙ্গে শুরু হয় সুর করা এবং গান গাওয়াও।
১৯৬৪ সালে ‘কারোয়ান’ চলচ্চিত্রে তার গাওয়া ‘যব তোম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে’ গানটি পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর শবনম-রহমান অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্র ‘দর্শন’ ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর এর গানগুলোর জন্য শ্রোতামনে স্থান করে নেন বশির আহমেদ। বাকিটুকু ইতিহাস।
বশির আহমেদ ছিলেন একাধারে সংগীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন গুণী এই শিল্পী।
পরিতাপের বিষয় হলো, গানের এই কিংবদন্তিকে নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন এখনো চোখে পড়েনি সংগীতাঙ্গন কিংবা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। এইসব বিষয়গুলোতে উদাসীনতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা হচ্ছে সংগীতের নানা রকম সংগঠনগুলোকে। গানের উন্নয়নের নাম করে এসব গড়ে উঠলেও দিন দিন সেগুলো ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারেরই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তাতে কী! বশির আহমেদরা কোনো আনুষ্ঠানিকতায় বাঁচেন না। তার মতো গুণীরা কর্মময় জীবন দিয়ে ভালোবাসায় অমরত্ব নেন কোটি মানুষের মন-মন্দিরে। তেমনি বশির আহমেদও থেকে যাবেন চিরকাল; যতদিন বাংলায় গান হবে। আমরা সবাই তাকে গানের প্রেমিক বলেই ডাকব। তার শান্তিতে ঘুমাক।
এলএ