‘যাদের তারকা বলা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই তারকা নন’
বিটিভিতে একসময় ‘ছায়াছন্দ’ নামে চলচ্চিত্রের গান নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার হতো। চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলো এটি। যেদিন এই ছায়াছন্দ প্রচার হতো সেদিন দর্শকদের মধ্যে এক ধরণের আনন্দ বিরাজ করত। কালের স্রোতে চলচ্চিত্র হারিয়েছে তার সোনালি দিন। সেইসঙ্গে এই অঙ্গন প্রাসঙ্গিক অনুষ্ঠানও আর তেমন করে জনপ্রিয় হয়নি। তবে অনেকেই চেষ্টা চালিয়েছেন এবং এখনো চেষ্টা করছেন টেলিভিশনের পর্দায় চলচ্চিত্র নিয়ে বর্ণিল আয়োজনে কিছু উপস্থাপনের। তার বেশিরভাগই ব্যর্থতায় ভেসে গেছে।
আর সফল অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে টিকে গেছে এশিয়ান টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘মুভিবাজার’। সৈকত সালাহউদ্দিনের পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় দেশীয় চলচ্চিত্রের এই অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানটি গেল বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ গৌরবময় ১২৫তম পর্ব প্রচার করেছে। এই মাইলফলক ছুঁয়ে যাওয়ায় ‘মুভিবাজার’কে অভিনন্দন। এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে নানা কথা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে জাগো নিউজের বিনোদন বিভাগের মুখোমুখি হয়েছেন অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক এবং এশিয়ান টিভির অনুষ্ঠান প্রধান (অতি:) সৈকত সালাহউদ্দিন।
জাগো নিউজ : প্রথমেই অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে ও মুভিবাজারকে....
সৈ. সালাহউদ্দিন : ধন্যবাদ আপনাকে ও জাগো নিউজকে।
জাগো নিউজ : চলচ্চিত্র নিয়ে আজকাল খুব বেশি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চায় না টিভি চ্যানেলগুলো। সেখানে আপনি মুভিবাজার নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। এরইমধ্যে ১২৫তম পর্বের একটি অংশও প্রচারিত হয়ে গেছে। কেমন লাগছে?
সৈ. সালাহউদ্দিন : অবশ্যই এই পথচলা আনন্দের। মুভিবাজারের সঙ্গে পথচলার শুরুতে এত বড় সাফল্যের কথা ভাবিনি। তবে আমি শুধুমাত্র এইজন্য আনন্দিত নই যে আমার পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় এশিয়ান টিভিতে দেশীয় সিনেমার বাজার বিষয়ক অনুষ্ঠান মুভিবাজার ১২৫তম পর্ব বা ১২৫তম গৌরবময় সপ্তাহ উদযাপন করছে! আনন্দিত কারণ দেশীয় সিনেমার একটি অনুষ্ঠান বড় স্পন্সর নিয়ে যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে! এর জন্য হলিউড বা বলিউডি সিনেমা নিয়ে কোনো অংশ প্রবেশ করাতে হয়নি। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সাজানো পর্বগুলোও- যেমন সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন কেন সিনেমায় অনুপস্থিত বা শুধু শিল্পী নয় কুশলীদের নিয়েও পর্ব টিআরপিতে এসেছে!
জাগো নিউজ : মুভিবাজারে তো প্রতি পর্বেই একজন অতিথি হাজির হতে দেখা যায়। অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো মাথায় ছিলো?
সৈ. সালাহউদ্দিন : আমরা প্রাধান্য দিয়েছি চলচ্চিত্রের মানুষদেরকেই। যারা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, চলচ্চিত্রকে নিয়ে ভাবছেন। অভিনয় শিল্পী থেকে শুরু করে পরিচালক, কণ্ঠশিল্পী, প্রযোজক, প্রদর্শক, টক শো ব্যক্তিত্ব এমনকি র্যাবের পাইরেসি দমন ইউনিটের প্রধান পর্যন্ত অনেকেই এসেছেন মুভিবাজারে।
জাগো নিউজ : মুভিবাজারের প্রথম অতিথি কে ছিলেন?
সৈ. সালাহউদ্দিন : চিত্রনির্মাতা এফ আই মানিক ছিলেন আমাদের প্রথম অতিথি। তারপর অনেকেই এসেছেন। ধারাবাহিকতায় মুভিবাজার রজত জয়ন্তী ২৫ তম পর্বে অতিথি হয়েছেন রাজ্জাক, সুবর্ণ জয়ন্তী ৫০ তম পর্বে সোহেল রানা, হীরক জয়ন্তী ৭৫ তম পর্বে ফেরদৌস এবং মুভি বাজার ১০০ তম পর্বে অতিথি হয়েছেন জনপ্রিয় জুটি শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস। ১২৫তম পর্বে হাজির ছিলেন নন্দিত চিত্রনায়ক ফারুক।
জাগো নিউজ : মুভিবাজারের পর্বগুলোতে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়?
সৈ. সালাহউদ্দিন : আলোচনায় এসেছে চলচ্চিত্রের প্রায় সবই। দেশের বাজার, হলের পরিবেশ, বিদেশের বাজার, যৌথ প্রযোজনা বিতর্ক, সিনেমার প্রযুক্তি, বক্স অফিস না থাকা, সিনেমার অ্যাকশন, কমেডি, নাচের কোরিওগ্রাফি, কাহিনির সংকট, সংলাপের মান, গুরু-শিষ্য, বিনিয়োগের সংকট, সেন্সর নীতিমালা, এফডিসির আধুনিকায়ন, সিনেমায় কর্পোরেট বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা, পাইরেসি, সিনেমাটোগ্রাফি, সিনেমা নির্মাণে নানা সমস্যা থেকে সিনেমার প্রসারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের নামে কেনো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনার নামকরণে দেখা যায়না, জাতীয় বীরেরা কেনো সিনেমায় উপেক্ষিত এমনি নানা বিষয়।
জাগো নিউজ : মুভিবাজারের এই সাফল্যটাকে কীভাবে অনুভব করেন আপনি?
সৈ. সালাহউদ্দিন : অবশ্যই ভালো লাগে। তবে এই সাফল্যের ভাগ শুধু আমার নয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষই আজকের ‘তারকা’ অনুষ্ঠান ‘মুভিবাজার’র জন্য পরিশ্রম করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই মুভিবাজার টিমকে ও এশিয়ান টিভির কতৃপক্ষকে। পাশাপাশি ধন্যবাদ দিতে হয় স্পন্সর ফেয়ার এন্ড লাভলি ও পার্টনার স্টার সিনেপ্লেক্স পরিবারকেও। আর খুব ভালো লাগে অনুষ্ঠানে আসা সিনেমার পিলারগুলো যখন বলেন মুভিবাজার নিয়মিত দেখেন বা নতুন প্রজন্ম যখন মনে করেন মুভিবাজার শোতে আসা দরকার সত্যি ভালো লাগে খুব। মুভিবাজার ১২৫ উৎসব পর্বে চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী ফারুক যখন বলেন, একটাই অনুরোধ মুভিবাজার যেনো কখনো বন্ধ না হয় তখন আমাদের পুরো টিম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।
জাগো নিউজ : মুভিবাজারের বরাতে একসমের তূখোড় বিনোদন সাংবাদিক সৈকত সালাহউদ্দিন এখন তারকা উপস্থাপক। কেমন উপভোগ করেন বিষয়টি?
সৈ. সালাহউদ্দিন : আমার বন্ধু নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস একটি কথা বলেন, ‘যার নামটি মনে করিয়ে দিতে হয়না সেই তারকা। অকপটে বলি, মিডিয়ার বাইরে সাধারণ মানুষ আমার নামটি চট করে মনে করতে পারেননা। তাই আমিও নিজেকে তারকা মনে করি না। সেই ২০১২ সালে চ্যানেল নাইন-এ সাড়া জাগানো তিনটি শো এবং ২০১৩ সাল থেকে ‘মুভিবাজার’র মতো একটি জনপ্রিয় শো- এর ১২৫তম পর্ব পার করেও নিজেকে তারকা ভাবিনা।
জাগো নিউজ : তবে বলছেন মুভিবাজার আপনাকে তারকা খ্যাতি দেয়নি?
সৈ. সালাহউদ্দিন : না। তবে মুভিবাজার নিজে তারকা হয়েছে। এই কথা সবাই মানবেন, দেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানের কথা বলা হলে দর্শক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের মানুষেরা চোখ বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গেই বলবেন ‘মুভিবাজার’। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। আমি নই, আমাদের পরিশ্রমের ‘মুভিবাজার’ তারকায় পরিণত হয়েছে। যখন পাবলিক প্লেসে যাই, দূর থেকে মন্তব্য শুনি বা তারা কাছে এসে ছবি তুলতে চান এই বলে যে- ওই যে মুভিবাজার করেন ওই লোকটা বা আপনার মুভিবাজার শোটা ভালো লাগে। চলচ্চিত্রের মানুষেরাও দাবি করেন, দেশে চলচ্চিত্র নিয়ে পরিপূর্ণ অনুষ্ঠান ‘মুভিবাজার’। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অনেকের মতো মুভিবাজারেরও ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ মুভিবাজার তারকা হতে পেরেছে।
জাগো নিউজ : তাহলে আজকাল যাদের তারকা বলা হচ্ছে তাদের বিষয়ে কী বলবেন?
সৈ. সালাহউদ্দিন : আমাদের দেশে তারকা শব্দটা আজকাল যার তার নামের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। এই সময়ে যাদের তারকা বলা হচ্ছে তাদের ৯৯ শতাংশই তারকা নন। এটা পাবলিক প্লেসে গেলে সেইসব কথিত তারকারাও অনুধাবন করেন। তাদের নামতো দূরের কথা এইসব স্বঘোষিত ও খবরের পাতার তারকারা ‘কী’ করেন সেটাও সাধারণ মানুষ এমনকি মিডিয়ার অনেকেই বলতে পারেন না। তারকা বলার ক্ষেত্রে ফ্যানদের ভাষা ও মিডিয়ার ভাষা এক হয়ে যাচ্ছে। কোনো একজন শিল্পীর গুটিকয়েক ভক্ত তাদের ভালোবাসার জায়গা থেকে তারকা বলছে মিডিয়াও তাকে তারকা বলে দিচ্ছে কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই। এমনকি কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে কাউকে কাউকে তারকা বলছেন, আর কোনো কিছু না ভেবে গণমাধ্যমও তাদের তারকা বলে লিখে দিচ্ছে।
জাগো নিউজ : তারকা প্রসঙ্গেই তবে আরো একটি বিষয় জানতে চাই। আজকাল ফেসবুক তারকার যুগ শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন?
সৈ. সালাহউদ্দিন : এ বিষয়ে আমার নতুন করে কিছুই বলার নেই। ফেসবুক কখনো তারকা বানাতে পারে না। আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবাই তারকা। বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র তারকাও রয়েছেন যাদের ফেসবুকে ফ্যান-ফলোয়ার প্রচুর। কিন্তু আমরা মুভিবাজার থেকে দর্শক জরিপ চালিয়ে দেখেছি তাদের কোনো খবরই নেই দর্শকদের কাছে। এমনকি ইউটিউবেও ‘ভিউয়ার’ বেশি হওয়া তারকাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
জাগো নিউজ : মুভিবাজারে অনেক পরিচালক, প্রযোজক ও কলা কুশলীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার। পাশপাশি নিজেও চলচ্চিত্রের সাংবাদিকতায় দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে চলচ্চিত্রের মন্দাবস্থা কাটিয়ে সুদিনে ফিরতে কতোটা আশাবাদী আপনি?
সৈ. সালাহউদ্দিন : অনেক আশাবাদী। এটা ইতিবাচক বিষয় যে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় চলচ্চিত্রে কিছুটা সুদিন ফিরে এসেছে। আবারো দর্শকের মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। আমরা মুভিবাজারের ফেসবুক পেজে দেখেছি অসংখ্য মানুষ সেখানে সরব চলচ্চিত্রের খবর জানতে, প্রিয় তারকাদের খবর জানতে। দর্শকরা প্রতি সপ্তাহের আলোচনায় মতামত দিয়ে বিজয়ী হয়ে থাকেন। এখানে প্রচুর অংশগ্রহণ পাই। বছর শেষে লাখ ছাড়িয়ে দর্শক যখন প্রিয় সিনেমা, অভিনেতা, অভিনেত্রী নির্বাচন করেন তখন আমরা অনেক আশাবাদী হই। ভাবতে পারি, চলচ্চিত্রের দিন ফিরবেই। আবারো আনন্দ আমেজ নিয়ে মানুষ হলে যাবে ছবি দেখতে।
এলএ