সাক্ষাৎকারে মিশা সওদাগর
‘আমার অভিনয় জীবন নিয়ে আমি তৃপ্ত’
ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় খল অভিনেতা মিশা সওদাগর। তার তিন যুগের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দেশের সব শ্রেণির সিনেমাপ্রেমীর কাছে তিনি সমান গ্রহণযোগ্য। অভিনয়ে অনন্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জাগো নিউজের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জাগো তারকা’য় অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। তার সাক্ষাৎকারের অনুলিখন করেছেন- মিজানুর রহমান মিথুন
জাগো নিউজ: কেমন আছেন আপনি?
মিশা সওদাগর: জ্বি, আলহামদুলিল্লা, বেশ ভালো আছি।
জাগো নিউজ: আপনার কাছে প্রথমেই জানতে চাই, তিন যুগ অতিক্রম করছেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। কেমন লাগছে আপনার? কেমন ছিল এই সুদীর্ঘ যাত্রাটা?
মিশা সওদাগর: এটা তো একটা লম্বা কাহিনি। এটা সংক্ষিপ্ত সময়ে বলা সম্ভব নয়। প্রথমে উপর ওয়ালাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবো। পাশাপাশি সিনেমা, পরিচালক প্রডিউসার, পরিবেশক এবং যারা সিনেমা দেখেন, মানে আমার প্রিয় ভক্ত-অনুরাগী তাদের প্রত্যেকের প্রতি ভালোবাসা জানাবো। তাদের সবার ভালোবাসা আমার প্রতি ছিল, আছে থাকবে বলে আমি মনে করি। নির্মাতা ও পরিচালকদের আমার প্রতি বিশ্বাস ছিল, তারা আমার ওপর কাজের আস্থা রেখেছেন, সেই সঙ্গে আমি সুস্থ ছিলাম এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। আমার স্ত্রীর আমার প্রতি অনেক সহযোগিতা ছিল বলে আমি আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। সবার ভালোবাসায় মিশা সওদাগর হতে পেরেছি। সব শেষে বলবো এ পর্যন্ত আসা একটা কঠিন জার্নি হলেও আমি সব মিলিয়ে অনেক হ্যাপি, অনেক আনন্দিত। আমার অভিনয় জীবন নিয়ে আমি তৃপ্ত।
আরও নিউজ: এবার ওয়েব সিরিজে দেখা যাবে মিশা সওদাগরকে
জাগো নিউজ: আপনি ১৯৮৬ সাল থেকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে কাজ করছেন। এত দীর্ঘ অভিনয় জীবনে আপনি নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরপর ভিলেন হিসেবে অভিনয় চালিয়ে গেলেন। ভিলেন ও নায়কদের পার্থক্যটা আপনি কেমন করে দেখেন?
মিশা সওদাগর: ভিলেনকে তো ‘খলনায়ক’ বলে বাংলায়। হিরোকে তো ‘নায়ক’ বলে । আমি নায়ক হিসেবে আসলে দুটো ছবি করে ছিলাম। একটা হচ্ছে ‘চেতনা’। আমার ওস্তাদ, মানে আমি যাকে আমার ফিল্মের ‘বাবা’ বলি, তিনি হলেন ছটকু আহমেদ। আমি তার প্রথম ছবিতে অভিনয় করেছি। ১৯৮৭ সালে এ ছবিটির শুটিং করি। তবে ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত অন্য একটি ছবি, এর নাম ‘অত্যাচার’। সেটাতে আমার একটা গান ছিল। গানটি ছিল মমতাজ আপুর সঙ্গে। এখন যেটিকে আইটেম সং বলে, গানটি ঠিক এরকম ছিল। এটাই আমার ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ানো। পরে আমি তরুণ হিরো হিসেবে কাজ করি। সে ছবির নাম ‘চেতনা’। এরপর আরও একটা ছবি করি, সেটা হচ্ছে প্রয়াত আলমগীর কুমকুম স্যারের ছবি। নাম ছিল ‘অমর সঙ্গী’।
আরও পড়ুন: ইসলামি গানের মডেল হলেন মিশা সওদাগর
জাগো নিউজ: এই সিনেমাটিও তো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল-
মিশা সওদাগর: জ্বি ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হয়। তবে এই ছবিতে আরও দুজন সিনিয়র নায়ক ছিলেন তারা হচ্ছেন জসীম ভাই এবং আলমগীর ভাই। কিন্তু যখন আমরা কাজ করি তখন তরুণরা কাজ করবে, তরুণরা নায়ক হবে –এই পরিবেশ তৈরি হয়নি। তারপর আমি একটা বিরতি দেই। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হুমায়ুন ফরীদি, তিনি শহীদুল ইসলাম খোকন ভাইয়ের ছবিতে আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে ব্রেক দিলেন। অন্যদিকে আমার প্রচুর ছবির অফার ছিল। এসব ছবির লোকজন বললেন, আপনার যে ভাচন-ভঙ্গি তাতে যদি এন্টি হিরোর অভিনয় করেন, খুব ভালো লাগবে। তবে প্রথম প্রথম আমি না করে দিয়েছি। বলেছি না, না আমি এসব চরিত্রে অভিনয় করবো না। আমার শখ ছিল, তাই এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। কয়েকটা করেছি, ওটাই যথেষ্ট। পরে যখন দেখি শ্রদ্ধেয় হুয়ায়ুন ফরীদি এসব চরিত্রে অভিনয় করলেন, তখন আমি বেশ অনুপ্রাণিত হলাম।
জাগো নিউজ: তাহলে হুমায়ুন ফরীদি আপনার অনুপ্রেরণা?
মিশা সওদাগর: ভাবলাম হুমায়ুন ফরীদি যদি এসব চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন, সেখানে আমি কোনো ব্যাপারই নয়। তারপর আমি অভিনয় করি সালমান শাহর সঙ্গে তার প্রথম ছবি ‘আশা ভালোবাসা’য়। এতে নায়িকা ছিলেন শাবনাজ। নির্মাতা ছিলেন তোমিজ উদ্দিন রিজভী। এই ছবি করার পর থেকেই আমার যাত্রা শুরু হয়। আজ পর্যন্ত করে যাচ্ছি। নায়ক এবং সিনেমার যে পার্থক্য, সে বিষয়ে আমি বলতে চাই, একটা রাস্তা থেকে হলে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য একটা সিগন্যাল থাকে। একটা সিগন্যালে একটা বাতি হচ্ছে গ্রিন, অন্যটা রেড। রেড বাতি জ্বললে আপনি সামনে যাবেন না। আর গ্রিন বাতি জ্বললে আপনি যেতে পারবেন। এটা হচ্ছে গন্তব্যে পৌঁছার সারমর্ম। তেমনি একটি গল্পে দুটি চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে নায়ক অন্যটি হচ্ছে খল নায়ক। তাই আমি বলবো নায়ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, খলনায়কও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। মোট কথা হচ্ছে একে অন্যের পরিপূরক।
জাগো নিউজ: বলছিলেন সালমান শাহর সঙ্গে অভিনয়ের কথা। কেমন ছিল তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা?
মিশা সওদাগর: আমি বলবো অসাধারণ! অসাধারণ! আল্লাহ সালমান শাহকে বেহেশতের উত্তম জায়গায় রাখুন। এই দোয়া করি সব সময়। সে অসম্ভব একজন সাবলীল অভিনেতা ছিল। মানুষ হিসেবে তার কোনো তুলনা নেই। ভীষণ আবেগি একটা মানুষ ছিল সালমান। সবার সঙ্গে খুবই ভালো, খুবই চমৎকার ব্যবহার করতেন। এমন জনপ্রিয় লোক আমি খুব কম দেখেছি। তার প্রজন্মে সে অসাধারণ অভিনেতা ছিল। শুধু তাই নয়, সে বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিল। আউটডোর যেদিন শেষ হতো সেদিন প্রত্যেকে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী দিত। শুটিং ইউনিটের কাউকে উপহার দেওয়া থেকে বাদ দিত না। সালমান সম্পর্কে বলার মতো বিশেষণ আমার জানা নেই। নায়করাজ রাজ্জাকের যেমন সব ধরনের দর্শক ছিল, তেমনি সালমান সব শ্রেণির দর্শকের ভালোবাসা কুড়িয়ে ছিল। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন সালমান। সালমান তার সময়ে ছোটদের মধ্যে অনেক বড় নায়ক ছিল।
জাগো নিউজ: আপনি তিন যুগ ধরেই চলচ্চিত্র অঙ্গনে আছেন। অভিনয় করে যাচ্ছেন। সালমান শাহ মারা যাওয়ার পরে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যে ধাক্কাটা লেগেছে আপনি এর একজন অন্যতম সাক্ষী। সেই সময়টা সম্পর্কে যদি একটু বলেন-
মিশা সওদাগর: আমি তখন এফডিসিতে ‘স্বামী কেন আসামী’ ছবির শুটিং করছি। তখন শুনি যে সালমান শাহ মারা গেছে। তারপর আমরা শুটিং ফেলে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। সেই সময়টার কথা চিন্তাই করা যায় না। সালমান মারা যাওয়ার পর চলচ্চিত্রে অনেকটা স্থবির অবস্থা তৈরি হয়। সালমান মারা যাওয়ার পরতো অনেক পরিচালক প্রযোজকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এরপর সালমানের অসম্পূর্ণ ছবি যখন রিলিজ হয়েছে, তাও সুপার ডুপার হিট হয়েছে। এতেই বোঝা যায় তার জনপ্রিয়তা কেমন ছিল। গ্রহণযোগ্যতা কেমন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সালমানকে দেখলে নায়ক মনে হতো না। মনে হতো আমার বাসার ছোট ভাই। আমার পাড়ার একজন প্রতিনিধি। ভীষণ স্মার্ট। চিরচেনা মুখ। তার বাচন-ভঙ্গি, তার অভিনয়ের কলাকৌশল ছিল অনন্য নৈপুণ্যে ভরা। তার সব গুণ এবং আচরণ খুব আসলীল ছিল।
জাগো নিউজ: সালমান শাহর তো সংলাপ বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল-
মিশা সওদাগর: সালমান সিনেমার সংলাপ বলার ধরন পরিবর্তন করে দিয়েছিল। সালমান সংলাপ নয়, যেন সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতো। সেই সঙ্গে অসম্ভব ফ্যাশন সচেতন ছিল। সব মিলিয়ে একজন সুপারস্টারের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার তা সালমানের মধ্যে ছিল পরিপূর্ণভাবে।
এমএমএফ/এএসএম