ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

অনন্য মামুনের ‘রেডিও’ দেখলাম পদ্মার পাড়ে, গ্রামবাসী দেখলো শুটিং

লিমন আহমেদ | প্রকাশিত: ০৭:০৭ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বসন্ত আসা ছাড়া শহরে নতুন কিছু নেই। অফিস টু এফডিসি তারপর ঘরে ফেরা। মাস দেড়েক ধরে চক্রাকারে জীবন এভাবেই চলছিল। মন ক্লান্তিতে বিষণ্ন। তাকে বোঝাতে চাইলাম, ‘একদিন ছুটি হবে’ সংলাপ আওড়ে। খুব করে চাইছিলাম একবার ছুটি হোক। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও দলবেঁধে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো যাবে। দায়িত্বের চাপ নয়, কেবলই উপভোগ হবে মুখ্য।

অবশেষে ছুটির দিনটা চলেই এলো। হুট করেই। উপলক্ষ বন্ধুবর চলচ্চিত্র পরিচালক অনন্য মামুনের সিনেমা ‘রেডিও’। শুটিং দেখতে যাওয়া হবে। গন্তব্য মানিকগঞ্জের রামকৃষ্ণনগরের পদ্মার ঘাট। সঙ্গী চার গীতিকবি-সাংবাদিক জাহিদ আকবর, এ মিজান, রবিউল ইসলাম জীবন ও এন আই বুলবুল। আরও ছিলেন স্নেহভাজন সহকর্মী অনিন্দ্য মামুন, মাহবুবর রহমান সুমন, মাজহারুল ইসলাম তামিম, মিঠুন আল মামুন ও সমকালের এক ক্যামেরাম্যান। এদের সঙ্গেই কাজের দিনটা শুরু হয় এবং শেষ। স্বভাবতই আড্ডার মেজাজে ছুটির আমেজে ভ্রমণের আনন্দে মন মেতেছিল।

আনন্দের কারণ ছিলেন ‘রেডিও’ সিনেমার জুটি রিয়াজ-মমও। প্রায় ১৫ বছর পর তারা সিনেমার জুটি হচ্ছেন। তাদের একসঙ্গে শুটিং করতে দেখা নিয়ে একটা আগ্রহ। কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে থেকে আমাদের কালো রঙের হায়েস গাড়িটি যাত্রা করলো সকাল ৮টা ১৯ মিনিটে। রসিক ড্রাইভার জহির খানের সংগীতপ্রীতির হাত ধরে গানে-চিৎকার আর আড্ডায় জমে উঠেছিল যাত্রা। হেমায়েতপুর পেরিয়ে সকালের নাস্তা আর যেতে যেতে পথে সুন্দর লোকেশন দেখে ছবি তোলার বিরতি ভ্রমণকে বাড়তি আনন্দ দিয়েছে।

মানিকগঞ্জের রামকৃষ্ণনগরে যখন নামলাম দুপুর তখন। খানিক হাঁটতেই দেখতে পেলাম লোকজনের ভিড়। নারী ও মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। অনেকে সাজগোজও করে এসেছেন নায়ক-নায়িকার দর্শন পেতে। শুটিং চলছে দেখে পরিচালককে বিরক্ত না করে চলে এলাম নদীর ধারে। খোলা আকাশের নিচে বিশাল নদী পদ্মাকে দেখে মন হাহাকার করে উঠলো। অদ্ভুত এক ভালো লাগা। ঘোরের মতো। নিমিষেই যেন জমে থাকা একঘেয়েমির ক্লান্তি ও বিষাদ ভেসে ভেসে অনেক দূরে মিলিয়ে গেলো নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে।

সবাই মিলে চললো ফটোসেশন আর আড্ডা। এরই মধ্যে খবর এলো ঘাটে যেতে হবে। এখানে শুটিং শেষ। এবার নতুন লোকেশনে ক্যামেরা চলবে। ঘাটে গিয়ে পরিচালকের সঙ্গে দেখা। কথা বিনিময়। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর সাদা রঙের টি-শার্টে ছোটখাটো একজন অনন্য মামুন, নির্মাণে তিনি বিশাল। টের পাওয়া গেলো ট্রলারে উঠতেই। বিশাল তার টিম। বিশাল তার আয়োজন। সেখানেই তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেতা রিয়াজ ও তার নায়িকা মমর সঙ্গে কুশলবিনিময়। কথা হলো ছবিটিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা নাদের চৌধুরী, প্রাণ রায়সহ বাকিদের সঙ্গেও।

অনন্য মামুনের ‘রেডিও’ দেখলাম পদ্মার পাড়ে, গ্রামবাসী দেখলো শুটিং

দীর্ঘ জলযাত্রা। প্রায় দেড় ঘণ্টা। মাথার ওপর ফাল্গুনের রোদ। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে হরিরামপুর থানার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের গঙ্গাদর্ধি চরে এসে পৌঁছালাম দেড়টার দিকে। পরিচালক স্পটে নেমেই শুরু করলেন শুটিং। অনেক দূরের যাত্রা। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে শুটিং। দম ফেলার ফুরসত নেই। তার টিমেরও সবাই বেশ মনোযোগী।

আমরা দশজন জায়গা নিলাম এক আমগাছের নিচে। গ্রামেরই এক ভাই বাড়ি থেকে পাটি এনে বিছিয়ে দিলেন। বলে রাখা ভালো, এই সফরে অনেক স্মৃতির ভিড়ে সবচেয়ে বেশি মধুর হয়ে থাকবে একটা চমৎকার গ্রামের মানুষদের দেখা ও জানার মুহূর্তগুলো। চর থেকে খানিক দূরে গ্রাম। বাড়ির সংখ্যা হাতেগোনা। মানুষও খুব কম। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাদের চাষবাসের জীবন। কিন্তু কী দারুণ তাদের ব্যবহারের সভ্যতা। কী চমৎকার তাদের আতিথেয়তা। কতই না মধুর তাদের আন্তরিকতা। সে গল্প পরে বলছি। আমগাছের নিচে বসে বিশ্রামের ফাঁকে হয়ে গেলো কিছু সংবাদ কার্যক্রম। কানে এসে বাজলো নায়ক রিয়াজের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। কাছে গিয়ে দেখা গেলো মমসহ বেশ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটা মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নহবত মাস্টার চরিত্রের রিয়াজ।

জানা গেলো, ছবির গল্পটা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের। তখন উত্তাল সারাদেশ। চারদিকে নানা রকম ঘটনা ঘটছিল। এর মধ্যে একটি অখ্যাত গ্রাম। যে গ্রামটির চারদিকে পানি। চরের মধ্যে গ্রাম। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। সব খবরই দেরিতে পৌঁছায়। সেই গ্রামের দুটি রেডিও নিয়ে সিনেমার গল্প। যেখানে দেখা যায় দুই দল মানুষ। এক দল মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চায়, স্বাধীন হতে চায়। আরেক দল তাদের গলা চেপে ধরতে চায়। এটা নিয়েই ছবিটি এগিয়েছে। দেশপ্রেম, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি, মানব-মানবীর প্রেমও এখানে উপজীব্য হয়ে ধরা দেবে।

আবারও লোকেশন বদল। চর থেকে ‘রেডিও’ টিম যাবে গ্রামের ভেতরে। সেখানে শুটিং। এ সুবাদে ঘোড়ার গাড়িতে চড়া হয়ে গেল। ভাঙা রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে চেপে মনে হলো কিছু শখ পূরণ না হওয়াই ভালো। আধা মাইলের পথ। কিন্তু যেতে যেতে কোমড় তো বটেই, সারা শরীরে যেন ‘লাঠিপেটা’ করার মতো ব্যথা।

ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে মাটিতে নেমে যেন জীবন বাঁচলো, এমন ভাবই ছিল সবার চোখেমুখে। পেটের ক্ষিধেটা বাড়িয়ে দিলো এই ঝাকি-ধাক্কা। কিছু করার নেই। পরের বাড়িতে গেলে তাদের নিয়মেই খেতে হয়। তাই খাবার কখন আসবে সে নিয়ে ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে শুটিং দেখায় মন দিলাম সবাই। এর মধ্যে অনেকে মনোযোগ দিলেন পাশেই তিনটি বরই গাছে। গীতিকার-সাংবাদিক রবিউল ইসলাম জীবন প্রথম ভয়ে ভয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যোগ দিলেন অভিনেতা প্রাণ রায়। এরপর একে একে সবাই। আমিও বাদ থাকি কেন। ছোট একটা লাঠি নিয়ে লাল হয়ে থাকা পাকা বরই পেরে খেতে শুরু করলাম। একটুপর হাজির গাছের মালিক। ভয় যখন মনে মনে তখন গাছমালিক বলে উঠলেন, ‘আপনারা বসেন, আমি পাইরা দিতাছি।’ বলেই কাকে যেন ডাকলেন বরই পারতে। ব্যস।

অনন্য মামুনের ‘রেডিও’ দেখলাম পদ্মার পাড়ে, গ্রামবাসী দেখলো শুটিং

বাড়ির ভেতর থেকে এলো লবণ, কাঁচামরিচ। শুটিং স্পট হয়ে উঠলো বরই খাওয়ার স্পট। এদিকে ধীরে ধীরে বাড়ছে মানুষ। রিয়াজকে দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন সবাই। নারী দর্শনার্থিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রিয়াজ আসবে তারা আগে থেকেই জানতেন। দুপুরে খেয়েটেয়ে তাই কাজ শেষ করে এসেছেন। এক বৃদ্ধা জানালেন, এ গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে এক মাস আগে। টিভি নেই। গ্রামের ছেলে-বুড়োরা গ্রামের বাজারে গিয়ে টিভি-সিনেমা দেখে। নারীরাও যায় মাঝে মাঝে। তারা রিয়াজকে চেনেন। শাবনূরের সঙ্গে সিনেমা করে রিয়াজ। ভালো লাগে তাদের। আজ চর্মচোখে দেখার সুযোগ পেয়ে ছুটে এসেছেন। নায়িকা মমসহ বাকিদের দেখলেন বাড়তি ভালোলাগা থেকে। সহজ সরল মানুষ সব। মন থেকে কথা বলেন। মন থেকে হাসেন। কোথাও কোনো মেকি বা কৃত্রিম কিছু নেই।

আন্তরিকতা টের পাওয়া গেল গীতিকবি ও সাংবাদিক জাহিদ আকবর ভাই যখন হাত মুখ ধুতে একটা বাড়িতে ঢুকলেন। সেই বাড়ির লোকজন এমনভাবে অস্থির হলেন যেন বাড়িতে জামাই এসেছে। পেঁপে, স্যালাইন-বেলের শরবত; কতকিছু। একটা কিছু চাওয়াও বিপদ। সঙ্গে আসে আরও তিনটে। এমন সারল্য আতিথেয়তা তো শহরে দেখা হয় না। শহরের মানুষ হিসেবে তাই বিব্রত লাগে বৈকি। গ্রামের এইসব মানুষ স্মৃতিতে থাকবেন চিরকাল।

অনন্য মামুন এসে ডাকলেন পদ্মার পাড়ে ফিরে যাবেন বলে। খাবার এসেছে। আপাতত শুটিং শেষ। ফেরা হলো। ভ্রমণের ক্লান্তি, রোদের তাপ, হাঁটাহাঁটির কষ্ট ও ক্ষুধায় শরীর যখন বিদ্রোহ করবে এমন সময় খাবার পেয়ে মনটা চনমনে হয়ে উঠলো। বেশ বিশাল আয়োজনই বলতে হবে। একটি রিমোট এড়িয়ায় ছোটখাটো বিয়ের আয়োজনে আপ্যায়ন করলেন অনন্য মামুন। খেতে খেতে জানালেন ‘রেডিও’ নিয়ে কিছু কথা। এখানে থাকবেন ১ মার্চ পর্যন্ত। আট দিনে শেষ হবে পরিচালক অনন্য মামুনের এই সিনেমার শুটিং।

তরঙ্গ প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মিত সিনেমার প্রিমিয়ার হবে আগামী ৭ মার্চ। তবে মুক্তি এখনও চূড়ান্ত নয়। এত দ্রুত ছবির সব কাজ শেষ করতে পারবেন? প্রশ্নটা শুনেই অনন্য মামুন একগাল হাসলেন। তার উত্তর, ‘ইনশাল্লাহ। দেখা যাক।’

অনন্য মামুনের ‘রেডিও’ দেখলাম পদ্মার পাড়ে, গ্রামবাসী দেখলো শুটিং

খাওয়া শেষে আড্ডা হলো রিয়াজ, নাদের চৌধুরীর সঙ্গে। একে একে আরও অনেকের কাছেই শোনা হলো এই ছবিতে তাদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা। ফাঁকে ফাঁকে পরিচালক আরও কিছু দৃশ্যের কাজ শেষ করলেন। দেখতে দেখতে বেলা পড়ে গেল। নামছে অন্ধকার। ঠান্ডাও জমতে শুরু করছে। সব গুছিয়ে পরিচালক উঠলেন ট্রলারে। বিদায়ী দৃষ্টিতে গঙ্গাদর্ধি চর ও দূরে মায়ায় ভরা মানুষগুলোর গ্রামকে দেখে নিলাম আরও একবার।

৫০ জনের কম হবে না মানুষ। নানারকম যন্ত্রপাতি তো আছেই। রাতের জলযাত্রা। অনেকেই খানিকটা আতঙ্কে আছেন। পরিচালক সব দেখেশুনে ট্রলার ছাড়ার অনুমতি দিতেই জলযানটি যেন চিৎকার করে উঠলো। ট্রলার চলছে।

ছোটবেলায় বড়রা ঘুম আসার টনিক দিতেন। বলতেন, ‘চোখ বন্ধ করে আকাশের তারা গুনতে থাকলে ঘুম চলে আসবে।’ গতকাল গঙ্গাদর্ধি থেকে রামকৃষ্ণনগরের ঘাটে ফিরতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, যখন কিছু করার থাকে না তখন আকাশের তারা গুনলে ভালোই সময় কাটে! ট্রলারে অনেক লোক। কেউ দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাদের একজন আমিও। বসন্তের বাতাসে বেশ ভালোই হিম হিম ভাব। অন্ধকার ভেদ করে পদ্মার বুক চিড়ে চলছে ট্রলার। পরিবেশটা বেশ আদুরে। অনেকেই তাই সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন, ঝিমিয়ে পড়েছেন। আমার সামনে বসা ছবির জুটি রিয়াজ ও মম গুটিয়ে রইলেন ঠান্ডার ঝুঁকি থেকে বাঁচতে। দু-একজন ফোনে মাথা নত করে ব্যস্ত রইলেন। আমি দেখলাম মাথার ওপর ফর্সা পরিষ্কার একটা আকাশ। কোটি কোটি তারা জ্বলছে। গুণে গুণে বেশ অনেক লম্বা সময়ই কেটে গেল। সঙ্গে গুণগুণ করে আগামাথাহীন গান। ঘাটে নোঙর করতে মিনিট তিনেক বাকি। হঠাৎই চোখে পড়লো আকাশের এক কোণে এক তারা। সে জ্বলছে আর নিভছে। পাশে থেকে এন আই বুলবুল বলে উঠলেন, ‘এর নাম নেপচুন’। কি জানি! আকাশে আমার জ্ঞান কম। তারাটিকে দেখতে দেখতে শুধু মনে হলো, ও উদিত হয়েছে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাবে বলে।

একটা দুর্দান্ত দিন কাটিয়ে ‘রেডিও’ টিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মানিকগঞ্জকে ছেড়ে এলাম। বিষণ্নতা ছুঁয়ে যেতে যেতে মনে হলো একটা অদৃশ্য রেডিও যেন বাজছে কাছে কোথাও। যেখান থেকে ভেসে আসছে বিষাদের সুরে, ‘মানুষকে এক জীবনে অনেক কিছুই ছেড়ে যেতে হয়। ব্যাপার না। আবার হবে। অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে।’

এলএ/জেআইএম

আরও পড়ুন