টিভিতে প্রত্যাশার নতুন বছর
আশি কিংবা নব্বই দশকের বাংলা টিভি নাটকগুলোর ইউটিউবে ঘোলাটে ও ঝাপসা ফুটেজ দেখে এখনো অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সে সময়ের নাটকের স্ক্রিপ্ট, নির্মাণ, অভিনয়শৈলী যেন আজ বাঙালির মনের জাদুঘরে স্থায়ী ঠাঁই নিয়েছে। মধ্যবিত্তের জীবন সম্পর্কিত হাসি-কান্না আর ভালোবাসার অনুরণন নিয়ে একের পর এক নির্মিত হয়েছিল দর্শক নন্দিত নাটকগুলো।
সাড়া জাগানো সে সময়ে যারা নাটক লিখতেন, নির্মাণ করতেন এবং অভিনয়ের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতেন তারা শুধু একাডেমিকভাবেই শিক্ষিত ছিলেন না, দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-লেখক-নাট্যকারদের কবিতা-উপন্যাস-নাটকও নিয়মিত পড়তেন। এতে করে সবসময়ই তারা শিল্প উদ্ভাবনের নতুন নতুন ক্ষেত্রের খোঁজ পেতেন। কিন্তু এখন যারা টিভি নাটকের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখছেন তাদের অধিকাংশেরই [সবার কথা বলছি না] নিজস্ব একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড যেমন নেই, তেমনি ব্যক্তিগত পড়াশোনাটাও কম। পাশাপাশি শিক্ষানবিশ পরিচালক হিসেবে দু’একটি নাটক করার পরেই কোন প্রযোজককে অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে নিজেই পরিচালক বনে যাচ্ছেন কেউ কেউ। সে নাটক আবার অনএয়ারেও যাচ্ছে। লাখ চারেক খরচ করা নাটক প্রযোজক বিক্রি করছেন দেড় লাখ টাকায়! এ তো গেল আনকোড়াদের কথা।
গত দুই ঈদে প্রসংশিত হয়েছিল বেশকিছু নির্মাতার নাটক। ব্যয়বহুল এই নাটক-টেলিফিল্মগুলো নির্মাণে যে অর্থ ব্যয় করেছেন কিছু প্রযোজক তার অর্ধেক দামে নাটক বিক্রি করছেন, এটা হয়তো ওই নির্দিষ্ট প্রযোজকদের শিল্পমনের তৃপ্তি। এর ফলে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন কিছু ভালো নির্মাতা। কারণ সব প্রযোজক তো আর একরকম লস দেয়ার মানসিকতার না। শিল্পের মান বুঝেন এমন নাট্য প্রযোজকের সংখ্যা এখন হাতে গুণা কয়েকজন। কিন্তু যে হারে বছরে নাটক নির্মাণ ও প্রচার হচ্ছে সে হিসেবে দেশে প্রযোজকের সংখ্যা সহস্রাধিক। এরা হয় ফূর্তি করতে মিডিয়াতে আসেন নয়তো মাছ-তরকারি ব্যবসার পাশাপাশি মিডিয়ায় সাময়িক পরিচিতির লোভে আসেন।
কোন পরিচালক কার পাডুলিপি নিয়ে কোন কোন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে নাটক নির্মাণ করছেন-সেটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। তারা আখেরে কতোটুকু লাভবান হচ্ছেন সেটাই বড় কথা। ২০১৫ সালেও টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে এ ধরনের অশিক্ষিত, রুচিহীন ফালতু প্রযোজক-নির্মাতা ও তথাকথিত অভিনয় শিল্পীর অভাব ছিল না । অভিনয় যে একটি নন্দিনিক শিল্প, সেটা আজকাল মনেই হয়না। ক্যামেরার সামনে উল্টা-পাল্টা সংলাপ বলে যাচ্ছেতাই অঙ্গিভঙ্গি করলেই যে অভিনয় হয়না এটা এ ধরনের ছাগল নামক অভিনয় শিল্পীদের কে বুঝাবে।
এক সময় যারা টিভি পর্যায় অভিনয় করতেন তারা মঞ্চ নাটকেও নিয়মিত ছিলেন। আবার অনেকে নিজের অধ্যবসায়-পরিশ্রম দিয়ে নিজ চেষ্টায় অভিনয়ের খুঁটিনাটি বিষয়াদি শিখে নিয়েছিলেন। এখনো অনেকে এরকম ভাবেই শিখছেন। কিন্তু কিছু মডেল কাম অভিনেতা-অভিনেত্রী [নিজেরাই দাবি করে] যাচ্ছেতাই ভাবে সংলাপ বলে নাটকের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন। তারা কেউ-ই বুঝতে পারেন না কিংবা চান না , মডেলিং ও অভিনয় এক বিষয় নয়।
তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, চ্যানেল কেন এ ধরনের নাটক প্রচার করছে? কারণ অধিকাংশ চ্যানেলেই আজকাল প্রোগ্রাম টিম বলতে কিছু নেই। মার্কেটিং এর কর্তা ব্যক্তিরাই কোন নাটক যাবে নির্ধারণ করেন। যার ফলে মারাত্মক বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে। পাশপাশি বিজ্ঞাপনী এজেন্সীর কিছু ব্যক্তি [সব এজেন্সীর কথা বলছি না] যারা নাটকের ‘ন’ জানেন না, তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছেন কে নাটক বানাবে, কে লিখবে আর কারা কারা অভিনয়টা করবেন। ফেসবুকে তথাকথিত ফ্যান ফলোয়ারের কথা বিবেচনায় নিয়ে কিছু পরিচালক অভিনয় না জানা উঠতি মডেলদের অভিনেতা-অভিনেত্রী বানিয়ে ফেলছেন। বিষয়টি শুধু দুঃখজনকই নয়, দারুণ হতাশার।
অনেকেই বলেন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে নাটক প্রচারের সময় বিজ্ঞাপনের আধিক্য বেশি থাকে। কথাটি মোটেও মিথ্যে নয়, যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রোগ্রাম টিম নেই অথবা মৃতপ্রায়, যেখানে মার্কেটিং টিমই চ্যানেলের প্রাণ কিংবা সর্বেসর্বা, সেখানে বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে প্রশ্ন তুলবে কে? নাটক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরপর বিজ্ঞাপন বিরতী তো আছেই। আজকাল নাটক চলাকালীনও নানা ঢং-এ বিজ্ঞাপন দেখতে দর্শকরা বাধ্য হন। স্ক্রিন ছোট করে বিজ্ঞাপন, চারকোনা বিজ্ঞাপন, তিনকোনা বিজ্ঞাপন, স্ট্রিপ আর উগির যন্ত্রণায় অনেকে নাটক দেখাই বন্ধ করে দিচ্ছেন মাঝপথে। একই রকম নাটকের গল্প, একই লোকেশন, একই অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাটক দেখতে দেখতে দর্শকরা বিরক্ত। এ সমাজে তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া কোন বিষয় ঘটে না বলে মনে হয় টিভি নাটকগুলো দেখে। দুনিয়াজুড়েই টেলিভিশন নাটকে বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে কাজ করা হয়। সেটা সীমিত পরিসরে হলেও। রিয়েলিস্টিক, ন্যাচারেলিস্টিক, এ্যাবসার্ড, এক্সপ্রেসনিষ্ট, কমেডি, স্যাটায়ার, রোমান্টিক। কিন্তু বাংলাদেশে কমেডি ও রোমান্টিক বাদে অন্য কোন প্রয়াস চোখে পড়েনা। যা হয় তাও আবার পার্কে কিংবা বাগানের দোলনায় বসে প্রেমের রগরগে কথাবার্তা। এর ফলে ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা চ্যানেলের সিরিয়ালে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন এদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শকরা। যারাই মূলত দেশের টিভি নাটকের দর্শক।
২০০০ সালের গোড়ার দিকে পাডুলিপির কিছু লাইনআপ নিয়ে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সতস্ফূর্তভাবে সংলাপ নিজের মতো করে তৈরি করার স্বাধীনতা দিয়ে, ই¤েপ্রাভাইজেন রিলেটেড অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে নাটক নির্মাণ শুরু করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। মোটামোটি জনপ্রিয়তাও পায় সে সময় এ ঘরনার এ্যাকটিং। কিন্তু মুশকিলটা ঘটে তার অনুসারি ভাইবেরাদার তথা সাগরেদদের অতিমাত্রায় ই¤েপ্রাভাইজেন করা নাটক নির্মাণের মাধ্যমে। না গল্প, না চরিত্র, না কোন বিষয়বস্তু-কোন কিছুই নাটকে নেই। এদের দেখলে মনে হয় নাটক নির্মাণ ও অভিনয় করা মামুলি বিষয়, ডালভাত। অন্যদিকে হাসি নামক সুন্দর বিষয়টি ভাড়ামীতের নিয়ে যাচ্ছে দেশের বেশকিছু নাট্য নির্মাতা। দর্শক এসব নাটক দেখে তো হাসেই না বরং ভ্রæঁ কুচকে চ্যানেল বদলে ফেলেন। চলে যান ভারতীয় তথা বিদেশী চ্যানেলে। কমেডির সাথে হিউমার ও স্যাটায়েরে রূপকগত পার্থক্যটি খুব স্পটভাবে বুঝার অবকাশ আছে বলে মনে হয়। আর বিশ্ব সংস্কৃতির উম্মুক্ত প্রবাহে বানের জলের মতো ঢুকছে বিদেশী চ্যানেল। অনেকটা বন্যা-বন্যা ভাব। এদের দাপটে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে এদেশের মানহীন চ্যানেলগুলো।
ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর আগ্রাসনে নিরূপায় হয়ে কোন সমাধান খুঁজে না পেয়ে অবশেষে নতুন টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভি ওইসব চ্যানেলের সিরিয়ালের মতো করে নির্মাণ করেছে বেশ ক’টি দীর্ঘ ধারাবাহিক। বিষয়টি এদেশের নাটকের জন্য অশনিসংকেত। কারণ, এদেশের টিভি নাটকের পরম্পরার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে তার থেকে বেরিয়ে এসে ওপার বাংলার পাডুলিপি ও নির্মাতা দিয়ে দীপ্ত টিভি তাদের সিরিয়াল নির্মাণ করলো যা দুঃখজনক। আমাদের দেশের নাট্যকার-নির্মাতার এতোই অভাব যে তারা আমদানী করছে পাডুলিপি-পরিচালক! তাহলে কি এদেশে কন্টেট ক্রিয়েটারদের দিন ফুরিয়ে গেছে? এখন তো মনে হচ্ছে, যে জাতি নিজের ভাগ্য ও সংস্কৃতি নিজেই ধ্বংস করে থাকে, তাদের কেন বাঁচাবে খোদাতায়ালা!
টিভি চ্যানেলগুলো এখন ঝুঁকছে ধারাবাহিক নাটক প্রচারে। একক নাটক কিংবা টেলিফিল্ম এখন দুই ঈদে প্রচার হয়। অন্যান্য বিশেষ দিবসেও কিছু নাটক প্রচার হয়, যার সংখ্যা খুব সামান্য। ২০১৫’তে নিয়মিত বিভিন্ন ধারাবাহিক প্রচার হলেও এদের মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। নির্মাতারা অবশ্য বাজেট ঘাটতির কথা বলেন অহরহই। বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। বছর বছর বাড়ি ভাড়া থেকে কাচা লংকা-সবকিছুর দাম বাড়লেও নাটকের দাম দিনকে দিন কমছে। মাত্র একদিনে এখন একটি একক নাটক নির্মাণ করছেন নির্মাতারা, যা বিস্ময়কর।
এতোসব হতাশার মধ্য দিয়ে আমাদের টিভি নাটক পার করেছে ২০১৫-এর প্রতিটি সময়। অবশ্য আশা জাগানো কিছু বিষয় যে একদম ছিল না তা কিন্তু নয়। গত ঈদে কিছু চ্যানেল নাটকের মানের বিষয়ে যেমন সচেতন ছিল তেমনি বিরতিতে প্রচারও করেছিল তুলনামূলক কম বিজ্ঞাপন। জিটিভি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা রেখেছিল। তবে বেশিরভাগ নাটক পুরনো হওয়ায় তাদের সেই উদ্যোগে দর্শকরা খুব বেশি উপকৃত হয়নি। এ বছরে টিভি নাটক ২০১৫’এর সমস্ত জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করি। মানসম্পন্ন রুচিশীল টিভি নাটক দেখে দর্শকরা বিমুখ হবে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের প্রতি। উম্মুখ হয়ে বসে থাকবে সবাই বাংলাদেশের টিভি নাটক দেখার জন্য। স্বপ্ন স্বপ্ন ঠেকলেও এমনটাই ভাবতে চাই।
লেখক : নির্বাহি সম্পাদক
পাক্ষিক বিনোদন
এলএ