শিল্পীদের আয়ের এখন প্রধান উৎস স্টেজ শো : আঁখি আলমগীর
অভিনয়ের চৌকাঠে জন্ম নিলেও সংগীত সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন সেই ছোটবেলা থেকে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন বেশ কিছু শ্রোতাপ্রিয় গান। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙে নতুন করে সাজানো তার একটা স্টাইল। সে কারণে তিনি আজও নতুনের মতোই সতেজ আর প্রাণবন্ত।
নিজস্বতা দিয়েই নন্দিত অভিনেতা বাবা আলমগীরের তারকাখ্যাতির বলয়কে পাশ কাটিয়ে হয়ে উঠেছেন গানের আঙিনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আঁখি আলমগীর। সম্প্রতি জাগো নিউজের বিনোদন বিভাগের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই গায়িকা। সেই আলাপের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য-
জাগো নিউজ : কেমন আছেন?
আঁখি : (চিরচেনা হাসি দিয়ে) আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি।
জাগো নিউজ : আপনার বাবা স্বনামধন্য চলচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক। আপনি নিজেও একটি ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সংগীতের প্রতি ঝঁকলেন কীভাবে?
আঁখি : আসলে অভিনয়ের মধ্যে বড় হলেও আমার ভালো লাগা ছিলো গানের প্রতি। গান আমার খুব ভালো লাগতে; শুনতে এবং গাইতে। মনে আছে আমি যখন ঠিকভাবে কথা বলতে শিখলাম মাত্র, তখন থেকেই ক্লাসিক গান শিখেছি ওস্তাদ আক্তার সাদমানের কাছে। এখনো শিখছি ওস্তাদ সঞ্জীব দে’র কাছে। তবে শিল্পী হবো বলে আমি গান শিখিনি। আমার ইচ্ছে ছিলো নিজের জন্য গাইব। এভাবেই গানের সাথে সখ্যতা। তখন পর্যন্ত গানটা শখের বশেই ছিলো। কিন্তু যখন কলেজে উঠি তখন নির্মাতা দেলোয়ার জাহান জন্টু আমার গান শুনে তার ‘বিদ্রোহী বধূ’ ছবিতে প্লেব্যাক করার জন্য অফার দেন। নিতান্ত শখের বসেই আমি ওই ছবিতে গানটি করি। গানটি প্রকাশ হলে সবাই খুব প্রশংসা করতে থাকেন। আমিও সাহস পেলাম নিয়মিত গান করার। অনেক গান করেছি আমি চলচ্চিত্রে। এভাবেই ধীরে ধীরে গানের নেশা আমার পেশায় পরিণত হয়েছে।
জাগো নিউজ : এ পর্যন্ত আপনার অ্যালবামের সংখ্যা কতো হবে?
আঁখি : আমার ১৮টি সলো এবং ৪০টির মত ডুয়েট ও মিক্সড অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আমার ‘প্রথম কলি বিষের কাঁটা’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘বোকামন’ প্রায় সব অ্যালবামই শ্রোতারা সাদরে গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন সময় প্রকাশ হওয়া এসব অ্যালবামে আমার বেশ কিছু গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তারমধ্যে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘জোর কা ঝাটকা’, ‘শ্যাম কালিয়া’, ‘বন্ধু আমার রসিয়া’সহ উল্লেখযোগ্য। এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। শ্রোতাদের জন্যই আমি অভিনয় থেকে গানে এসে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি।
জাগো নিউজ : ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রতে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। তারপরও অভিনয়টা ছাড়লেন কেন?
আঁখি : গানের মতো অভিনয়টাও আমার শখ ছিল। ভাত দে ছবিতে কাজ করাটাও তেমনি ছিলো। ছবিতে সবাই খুব অবাক হয়েছিলেন আমার অভিনয় দেখে। অনেকেই বলেছিলেন অভিনয়ে নিয়মিত হতে। কিন্তু আমি অতোটা সিরিয়াস ছিলাম না। আর বাবাও চাইতেন আমি যেন আগে পড়ালেখাটা ঠিকভাবে সম্পন্ন করি। কারণ, আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম। এসব কারণেই অভিনয় আর করা হয়ে ওঠেনি। বড় যখন হয়েছি তখন তো গানেই ঝুঁকে গেলাম।
জাগো নিউজ : অভিনেতা বাবার পরিচয়টা আপনার প্রতিষ্ঠার পিছনে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন?
আঁখি : আমার বাবা একজন সফল মানুষ। ওনার মত সফল বাবার মেয়ে হতে পেরে আমি গর্বিত। তারপরও আমি সবসময় নিজের মত করে নিজের একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছি এবং পেরেছি। অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে আরো সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে।
জাগো নিউজ : তবে বলছেন আপনার সফলতার পেছনে আপনার বাবার ভূমিকা খুব একটা নেই?
আঁখি : তারকা হিসেবে বাবা আমার গানের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেননি। তবে একজন বাবা হিসেবে তিনি সবসময়ই আমার প্রেরণা। বাবা আমাকে সবসময় উৎসাহ দিয়ছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। শিল্পী হিসেবে আমি যতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি সম্পূর্ণটাই নিজের প্রয়াসে।
জাগো নিউজ : বিজ্ঞাপন ও মডেলিংয়ে আপনাকে কদাচিৎ দেখা যায়, এই কাজগুলো কেমন উপভোগ করেন?
আঁখি : আসলে আমি গানের মানুষ। কিছু অনুরোধ আসে যেগুলো না করা সম্ভব হয় না। তবে যে কয়টা কাজ করেছি সবার প্রশংসা পেয়েছি। এটা ভালো লাগে। আগামীতেও মানসম্পন্ন বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব পেলে কাজ করবো। কাজের একটু ভিন্নতা পাওয়া যায়।
জাগো নিউজ : সংগীত শিল্পী হিসেবে এখন পেশাদারিত্বের জায়গাটা কেমন?
আঁখি : এখন মার্কেট অনেক বড় হয়েছে। সেইসাথে পেশাদারিত্বের জায়গাটাও বিস্তৃত হয়েছে। তবে অতিমাত্রায় পেশাজীবী হতে গিয়ে গানের মানটা চলে গেছে তলানিতে। আমরা একসময় অ্যালবাম প্রকাশের স্বর্ণ যুগে ছিলাম। এখন আর অ্যালবাম চলে না। গান প্রকাশের নিত্য নতুন স্টাইল আসছে। সবাই লুফে নিচ্ছে। দুদিন পর সেগুলো বিতর্কিত হচ্ছে।
জাগো নিউজ : সবমিলিয়ে বর্তমান সংগীতাঙ্গনের অবস্থা কেমন দেখছেন?
আঁখি : সংগীতাঙ্গনের অবস্থা আগেও ভালো ছিল, এখনো ভালো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে অডিও বাজারের অবস্থা ভালো নেই। আগেই বলেছি অ্যালবাম কেউ কিনছে না। ছোট-বড় কোনো শিল্পীই অ্যালবাম কিনে শ্রোতাদের গান শোনাতে পারছেন না। যার ফলে গান করাটা এখন বাপের টাকায় পরের শ্রাদ্ধ করার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা শুধু আমাদের এখানেই নয়। সমগ্র বিশ্বেই গানের বাজারে মন্দাবস্থা চলছে। ভারতের ইএমডি’র বড়বড় শো রুমগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও গান বিক্রির ক্ষেত্রে পেরিবর্তন এসেছে। তারা প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে গানের বাজার সৃষ্টি করছেন। আমরা সেটা পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের শিল্পীরা খারাপ সময় পার করছেন। আমাদের এখানে কণ্ঠশিল্পীদের আয়ের প্রধান উৎস স্টেজ প্রোগ্রাম। তারপরই উল্লেখ করা যায় প্লেব্যাকের কথা। আজকাল সবাই চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকছেন। এ কারণে অবম্য চলচ্চিত্রে মানহীন গানও বেড়েছে। গান না জানা মানুষ হুট করে একটা গান দিয়ে তারকাখ্যাতি পেয়ে যাচ্ছেন। সেই খাতিরে কিংবা সুসম্পর্ক দিয়ে তারা চলচ্চিত্রে গাইছেন। কিন্তু তাদের গান মানুষ নিচ্ছে না। শ্রোতাপ্রিয়তাই যে শিল্পের মাপকাঠি নয়- এটা সবাই ভুলতে বসেছেন। যার ফলে আগে দেখতাম চলচ্চিত্র ব্যবসা করতো হিট গান দিয়ে। আর এখন হিট বড় পরিচালক কিংবা নায়ক-নায়িকারা গান হিট করেন।
জাগো নিউজ : অডিও বাজায়ের এই মন্দা কাটানো কিভাবে সম্ভব?
আঁখি : আসলে এ বিষয়টা আমি অতোটা বিশ্লেষণ করতে পারব না। দীর্ঘদিন ধরেই তো সংগীতের অনেক প্রাজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিত্বরা এটা নিয়ে ভাবছেন। তারাই ভালো বলতে পারবেন কী করে আমরা এই দুঃসময় থেকে বের হতে পারি। তবে আমি মনে করি স্টেজ শো শিল্পীদের উপার্জনের অন্যতম মোক্ষম পন্থা হতে পারে। তাই এই ব্যাপারে সিরিয়াসলি কিছু ভাবা উচিত শিল্পী ও সংগীত সংশ্লিষ্ট মানুষ-সংগঠনগুলোর।
জাগো নিউজ : বর্তমান ব্যস্ততা কি নিয়ে?
আঁখি : এখন স্টেজ শো-এর ভরা মৌসুম চলছে। তা নিয়েই ব্যস্ত আছি। নানা স্থানে দৌড়াতে হচ্ছে কনসার্টে অংশ নেয়ার জন্য। খানিকটা ধকল গেলেও বেশ উপভোগ করি এটা। শ্রোতাদের সামনে সরাসরি গান করার আনন্দটাই অন্যরকম। কথা চলছে আগামী মাসেই দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি কনসার্টে গাইতে যাবার। এছাড়া ছবিতে প্লেব্যাক তো করছিই। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের শোতেও হাজির হচ্ছি। এইতো, এভাবেই চলে যাচ্ছে দিনকাল...
জাগো নিউজ : নতুন যারা গান করতে আসছেন তাদের জন্য আপনার কী নির্দেশনা থাকবে?
আঁখি : একজন শিল্পীকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হয় নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য। কেননা আমি ভালো মানুষ না হলে ভালো শিল্পী কখনোই হওয়া যায় না। আর গান যারা পেশা হিসেবে নিয়েছে বা নিবে বলে ভাবছে তাদের প্রতি অনুরোধ রইল গান ভালো করে শিখে, বুঝে নিতে হবে। সিনিয়রদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করতে হবে প্রেরণা হিসেবে, শিক্ষা হিসেবে।
এনই/এলএ