অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন মোশাররফ করিম, ছাত্রের আবেগঘন স্মৃতিচারণ
বিশ্বজুড়ে অনেক তারকাই আছেন যারা শোবিজে পা রাখার আগে নানা রকম কাজে জড়িত ছিলেন। অনেকে হয়তো কখনো ভাবেনওনি শোবিজে কাজ করবেন। ঘটনাচক্রে এসেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন। কেউ কেউ আবার ছোটবেলার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই অন্য পেশায় যুক্ত হন। যাতে অর্থের জোগান আসে। স্বপ্ন পূরণের জন্য সময় ব্যয় করা যায়।
তেমনি একজন বাংলাদেশের নন্দিত অভিনেতা মোশাররফ করিম। যিনি থিয়েটার করতেন অনেক আগে থেকেই। তবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন শিক্ষক হিসেবে। তার এক ছাত্র তৌহিদুর রহমান উদয় শিক্ষক দিবস উপলক্ষে একটি স্ট্যাটাসে সেই বিষয়টি আবার সামনে নিয়ে এলেন, যা নজর কেড়েছে নেটিজেনদের।
৬ অক্টোবরের সেই স্ট্যাটাসে উদয় লিখেছেন, ‘গতকাল শিক্ষক দিবস ছিল। বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম একজনকে নিয়ে লিখব। যাকে নিয়ে লিখব তাকে সবাই চেনে। তবে সবার চেনা আর আমার চেনার মধ্যে বিশাল বড় একটা পার্থক্য আছে। সবাই তাকে চেনে বাংলাদেশের একজন সেরা অভিনেতা হিসেবে, আর আমি চিনি আমার একজন অসাধারণ শিক্ষক হিসেবে। তার নাম মোশাররফ করিম, আমাদের শামীম স্যার। স্যার একজন বড় মাপের সেলেব্রিটি। এখানে এমন কিছু বিষয় আমি প্রকাশ করব, যা স্যার কখনই মিডিয়ায় প্রকাশ করেননি বা করতে সংকোচ বোধ করেছেন। সুতরাং আশা করব আপনারাও সেটা বিবেচনায় রাখবেন।
আমার বোন তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। কোচিং করছিল ই. হক মালিবাগ চৌধুরীপাড়া শাখায়। আমি সম্ভবত অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাপ চাইলেন আমিও যেন কোচিং সেন্টারে গিয়ে টুকটাক ক্লাস করে আসি। ফলে শুরু হলো বোনের সাথে আমার কোচিং-এ যাওয়া-আসা। মোশাররফ করিম স্যার এসএসসি লেভেলের নিচে ক্লাস নিতেন না। ফলে কয়েকমাস কোচিং-এ যাতায়াত থাকলেও এই মানুষটাকে দেখিনি কখনও।
কিন্তু তাঁর সম্পর্কে প্রচুর গল্প শুনতাম বোনের কাছে। অভিনয় পাগল এই মানুষটা ক্লাসে নাকি নিজের স্বপ্নের কথা বলতেন খুব। একদিন বড় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠতে দেখত ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু টেলিভিশনে সুযোগ হচ্ছে না। দুই একটা ছোট-খাটো চরিত্র পেলে সেটা নিয়ে ক্লাসে খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করতেন। শামীম স্যার ই হকের সেই শাখার দুই পরিচালকের এক জন ছিলেন সম্ভবত।
কোচিং এর স্যাররা আবার ক্লাস এইটকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। প্রায়ই চুপচাপ বসে থেকে ক্লাস না করেই চলে আসতে হতো মাঝেমধ্যে। একদিন সকালে ক্লাস করতে গিয়ে প্রথম দেখলাম মানুষটাকে। কোচিং সেন্টার প্রায় ফাঁকা বলা চলে। আমরা চারজন স্টুডেন্ট বসে আছি। দেখলাম গাট্টা-গোট্টা খাটো করে খুব গম্ভীর এক লোক হাত দুটো পেছনে দিয়ে সারা কোচিংময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। বুঝলাম সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। খুব গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করছেন। ভাবলাম হয়ত কোন ডায়ালগ বা সিন নিয়ে চিন্তা করছেন। আমাদের বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কোন ক্লাস। আমরা বললাম। স্যার বললেন, একটু অপেক্ষা করো, টিচার চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সেটাই স্যারের সাথে আমার প্রথম কথোপকথন। প্রথম দেখাতেই মানুষটাকে আমার খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে মনে হইছে।
আরেকদিনের ঘটনা। ক্লাসে বসে আছি। এক স্যার এসে জিজ্ঞাসা করলো আমরা ক্লাস এইট কিনা। হ্যা সূচক উত্তর দেয়ার পর তিনি আমাদের ব্যাগ ও বইপত্র নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। তাঁকে অনুসরণ করে বিরাট এক ক্লাসরুমে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দেখি ক্লাসরুম ভর্তি স্টুডেন্ট। এই কোচিং-এ এক ক্লাসেই এত স্টুডেন্ট পড়ে আমার জানা ছিল না। এটা ছিল ক্লাস নাইন-এর ক্লাসরুম। বিশাল রুমের কোথাও জায়গা নেই। ক্লাসে বোর্ডের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মোশাররফ করিম, সাধারণ একজন মানুষ। স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি শুম্মীর ভাই কীনা। আমি বললাম হ্যা। এখন বেঞ্চের মাঝে কিছু জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে বসতে হবে। সেটা করতে গেলে আবার অনেকগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে ডিঙাতে হবে। স্যার দুষ্টুমি করে বললেন, তোমরা তো সবাই ছোট মানুষ। কোলে তুলে নিয়ে বসিয়ে দেই, কী বলো? সারা ক্লাসে হাসির রোল।
যা হোক, ক্লাস শুরু হলো। বাংলা ব্যাকরণ। ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার- এগুলো সব ক্লাসে একই। সেজন্যই স্যার আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমার জীবনে প্রথম এবং শেষবার বুঝলাম যে বাংলা ব্যাকরণ একটা চমৎকার সাবজেক্ট। কিন্তু আসলেতো একটা রসকষহীন সাবজেক্ট। কিন্তু যে মানুষটা সীমিত সময়ের জন্য হলেও আমার কাছে এই অপছন্দের সাবজেক্টটাকেও আকর্ষনীয় করে তুলেছিলেন তিনি শামীম স্যার, আজকের মোশাররফ করিম। শিক্ষক হলে ছাত্রদের কীভাবে পড়াতে হয় সেটা আমি সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। সরকারী স্কুলে তো এই রকম শিক্ষাটা কোনদিন পাইনি। কীভাবে যে একটা ঘন্টা পার হয়ে গেল বুঝলামই না। মনে হচ্ছিল স্যার আরও কথা বলে না কেন।
শিক্ষকতা যে একটা আর্ট সেটা প্রথম আমি শিখেছিলাম মোশাররফ করিম স্যারের কাছ থেকে। সত্যি বলতে এরপর আমি আমার জীবনে এমন টিচার আর পাইনি কোথাও। নটরডেমে স্যাররা ভালো পড়াতেন, কিন্তু ক্লাস চলতে থাকুক ঘন্টার পর ঘন্টা সেই অনুভূতিটা আর কোনদিন পাইনি। স্যার ভালো থাকুক, নিজের অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দিয়ে দুই বাংলা মাতিয়ে রাখুক সেই কামনা করি। সেদিন যদি জানতাম স্যার একদিন এই অবস্থানে আসবেন তাহলে হয়ত স্যারের সাথে আমার একটা ছবি থাকত। কিন্তু আমরা তো আর দশটা সাধারণ মানুষের সাথে ছবি তুলে রাখি না।
স্যার তখন আর দশটা মানুষের মতোই সাধারণ ছিলেন যিনি নাটকে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য স্ট্রাগল করে যাচ্ছেন, আজকের মোশাররফ করিম তো হয়েছেন অনেক পরে এসে।’
এলএ/জেআইএম