মানহীন নাটকের জন্য দায়ি বাজেট ও চ্যানেলের অনিয়ম
বরেণ্য নাট্যকার, নির্দেশক প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুনের সংস্পর্শে সাজাদ হাসান বাবলু মিডিয়াতে প্রবেশ করেন ২০০১ সালে। এরপর তার পরিচালনায় অসংখ্য নাটকে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। নিজেই পরিচালনা করবেন বলে ‘তাহাদের যৌবনকাল’ নাটকটি লিখেছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যুতে তিনি আর সেটি করে যেতে পারেননি। পরে সেই নাটক নির্মাণের দায়িত্ব বর্তায় বাবলুর কাঁধে। তিনি দীর্ঘ তিন বছরের পরিকল্পনা আর প্রস্তুেতে সেটি নির্মাণ করেছেন। নাটকটি বর্তমানে এটিএন বাংলায় প্রচারিত হচ্ছে।
প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে চিত্রনায়িকা রোজিনার ছোট ভাই সাজাদ হাসান বাবলু পরিচালনায় সাথে জড়িত। জাগো নিউজকে তিনি জানালেন তার পরিচালনা জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা।
জাগো নিউজ : আবদুল্লাহ আল মামুনের সাথে আপনার শুরু গল্পটা জানতে চাই...
বাবলু : মামুন স্যারের সাথে আমার পরিচয় পারিবারিকভাবেই। সেই ছোটকাল থেকেই দেখে এসেছি তিনি আমাদের পরিবারের আসা যাওয়া করতেন। সেখান থেকেই তার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ২০০১ সালে আমি তখন ডিগ্রীতে পড়ি। অনেকদিন পর তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সেসময় তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন পড়ালেখা শেষ করে কি করতে চাই। আমিও বলেছিলাম হয়তো দেশের বাইরে চলে যাবো। তখন তিনি তার সাথে কাজ করতে বললেন। শুনে ভালো লেগেছিল। তখন চ্যালেন আইতে তার পরিচালিত ‘জোয়ার ভাটা’ নাটকটি প্রচার হচ্ছিল। খুব জনপ্রিয় নাটক ছিল সেটি। সেসময় ওই নাটকের শুটিং সেটে যেতাম, স্ক্রীপ্ট পড়ে দেখতাম। খুব ভালো লাগতো ব্যাপারগুলো। ধীরে ধীরে আমি মামুন স্যারের প্রিয় হয়ে উঠি এবং এক সময় তার সহকারী পরিচালক হসেবে কাজ শুরু করি।
জাগো নিউজ : আবদুল্লাহ আলা মামুনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন আপনি। একজন নির্মাতা হিসেবে তাকে কেমন দেখেছেন?
বাবলু : মামুন স্যারের নির্মাণ নিয়ে বলার ধৃষ্টতা আমি করব না। তিনি কত বড় মাপের নির্মাতা ছিলেন তা তিন যুগের দর্শক জানেন, এ দেশের অভিনয়ের মানুষেরা জানেন। নির্মাণের পাশাপাশি তার চিত্রনাট্য, অভিনয়- সবই ছিলো অসাধারণ। আমি এখনো তার মত একজন আপাদমস্তক শিল্পী দেখিনি। সেটা নাটক হোক, চলচ্চিত্র হোক কিংবা মঞ্চে। তারমত দ্বিতীয় কাউকে আমি আজও খুঁজে পাইনি। তিনি ছিলেন একাধারে একজন শক্তিশালী নির্মাতা, লেখক এবং অভিনেতা।
জাগো নিউজ : একজন উঁচুমাপের শিল্পী মামুনের বাইরে গিয়ে মানুষ হিসেবে তাকে কেমন দেখেছেন?
বাবলু : একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন শিল্পী মামুনের চাইতেও বড় মাপের। তিনি ছিলেন খুব মার্জিত। প্রায় এক যুগ তার সাথে কাজ করেও তার মুখ থেকে কোন দিন ঝাড়ি দিয়ে কিংবা বকাঝকা করা কোনো কথা শুনিনি। তিনি সবসময় ভদ্র ভাষায় কথা বলতেন। শুটিং সেটে সবার সাথে বসে আড্ডা ও খাওয়া দাওয়া করতেন। খুব সুন্দর করে ভুল শুধরে নিতেন। কেউ কষ্ট দিলেও নিজের কাছে সেটা চেপে রেখে ভাবতেন একদিন ওই মানুষটার ভুল ভাঙবে। এমন মানুষ, এমন শিক্ষক আজ আর চোখে পড়ে না। তার সবকিছুই অনুসরণ করার মতো।
জাগো নিউজ : আবদুল্লাহ আল মামুন কোন ধরণের নাটক বেশি নির্মাণ করতেন?
বাবলু : একজন নির্মাতা একেক রকম নাটক নির্মাণে অভ্যস্ত। কেউ রোমান্টিক, কেউ কমেডি, কেউ শহুরে আবার গ্রামীন প্রক্ষাপট নিয়ে নাটক নির্মাণ করেন। সেক্ষেত্রে স্যার বেশিরভাগ নাটক নির্মাণ করতেন পারিবারিক সুখ-দুঃখ এবং কোলাহল নিয়ে। সেখানে দর্শকরা নিজের ঘরের গল্প পেতেন, নিজের এবং পরিচিত মানুষদের গল্প দেখতে পেতেন। একারণে তার নাটকগুলোও সমাদৃত ছিলো। ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ ও সাফল্যে তিনি যে রেকর্ড তৈরি করেছিলেন তা আজও কেউ ভাঙতে পারেননি।
জাগো নিউজ : পরিচালক হিসেবে আপননার আত্মপ্রকাশ কিভাবে?
বাবলু : মামুন স্যারের মৃত্যুর কিছুদিন পর জামাল উদ্দিন নামের একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়। জামাল ভাই আগে মামুন স্যারকে দিয়ে ‘পরীবিবি’ নামের ২৬ পর্বের একটা সিরিয়াল নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেটার দেখভাল আমিই করতাম। তখন ওই ভদ্রলোক আমার কাজ দেখে পছন্দ করেছিলে এবং মামুন স্যার মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমায় বললেন পরিচালনায় আসার জন্য। তারপর জামাল ভাইয়ের প্রযোজনায় নাটক দিয়েই আমার পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু। তারপর বেশ কয়েকটি খণ্ড নাটক এবং সিরিয়াল নির্মাণ করেছি আমি। এখনো চলছে। আর এটাই করে যেতে চাই আমৃত্যু।
জাগো নিউজ : আপনার পরিচালনায় এটিএন বাংলায় ‘তাহাদের যৌবনকাল’ ধারাবাহিকটি প্রচারিত হচ্ছে। এটিতো আব্দুল্লাহ আল মামুনের চিত্রনাট্য ছিলো...
বাবলু : হ্যাঁ। এটি মামুন স্যারের অসমাপ্ত একটি কাজ। এই নাটকটি নির্মাণ করা স্যারের শেষ ইচ্ছে ছিলো। স্যার পারেননি। তার শিষ্য হিসেবে এটি নির্মাণ করে আমি গুরু দক্ষিণা দিয়েছি। স্যার বহুদিন আগেই এই চিত্রনাট্যটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দরিয়া পাড়ের দৌলতি চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করায় নাটকটি বানাতে পারেননি। তারপর তো স্যার একেবারে হুট করেই চলে গেলেন। তো স্ক্রিপ্টটি আমার কাছে ছিলো। ভাবলাম এই নাটকটি নিয়ে স্যার অনেক গল্প করতেন। নাটকের মিতা চরিত্রটি স্যারের খুব পছন্দের। তিনি বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীকে এই চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন। কিন্তু আমি যখন নির্মাণ করি তাদের বয়সটা বেড়ে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। তাই নাটকে মিতা চরিত্রে বাছাই করেছিলাম রোমানাকে। কিছু পর্ব কাজ করে হঠাৎ সে বিদেশে চলে যাওয়ায় এ প্রজন্মের মেধাবী অভিনেত্রী লাক্স তারকা আলভিকে নিয়েছি। ও খুব ভালো অভিনয় করছে। অন্যরাও দারুণ করছেন। বিশেষ করে বাঘা উকিলের চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম, মিতার মায়ের চরিত্রে ফেরদৌসি মজুমদারের অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়েছে। আমিও দারুণ সাড়া পেয়েছি। সবচেয়ে বড় আনন্দ আমি মামুন স্যারের স্বপ্নটি পূরণ করতে পেরেছি। তবে এই নাটক নির্মাণের পিছনে প্রযোজক জামাল ভাই, চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন বুলু ভাই, চিত্রনাট্য ব্যবস্থাপক লিমন আহমেদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেইসাথে নাটকটি প্রচারের ব্যবস্থা করায় এটিএন বাংলাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
জাগো নিউজ : নাটকটি কতো পর্বের?
বাবলু : প্রতি রবিবার ও সোমবার এটি প্রচারিত হচ্ছে ৮টা ৪০ মিনিটে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ পর্বের মতো হয়তো প্রচার হয়েছে। ইচ্ছে আছে এটিকে ৫২ পর্ব করার।
জাগো নিউজ : একজন নির্মাতা হিসেবে ভালো নাটক নির্মাণের প্রতিবন্ধকতাগুলো কি?
বাবলু : প্রথম পাঁচটি প্রতিবন্ধকতার কথা যদি আমাকে বলতে বলা হয় তবে আমি পাঁচবারই বলবো বাজেট। তারপরে যাবো চ্যানেলের অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রিতী ও অনিয়মের দিকে। আমাদের নাটকের বাজেট কমতে কমতে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে নাটক নির্মাণকে এখন চ্যারিটি কাজ মনে হয়; আর নিজেকে মনে হয় স্বেচ্চাসেবী। আর চ্যানেলগুলো নাটক বাছাইয়ে স্বজনপ্রিতী, বন্ধুপ্রিতী করছে। কাজ জানা মানুষদের নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ অশ্লীল ও আপত্তিকর সংলাপের নির্মাতারা দেদারছে নাটক নির্মাণ করে যাচ্ছেন। অভিনয়ের অ` না জানা তারকরা হয়ে যাচ্ছেন তারকা। তাদের নিয়ে নাটক নির্মাণের শর্ত জুড়ে দেয় চ্যানেল। এভাবেই নাটকের মানহীনতার জন্য চ্যালেনগুলো অনেক অংশে দায়ি। যা সত্যি বেদনাদায়ক। অথচ এই দেশে নাটকের ইতিহাস কতো গৌরবের। আমার বিশ্বাস শিগগির এ বিষয়গুলোর সমাধান হবে।
জাগো নিউজ : সাম্প্রতিক ব্যস্ততা কী নিয়ে?
বাবলু : তাহাদের যৌবনকাল তো প্রচারিত হচ্ছে এবং এটার শুটিং করছি। তাছাড়া আরো দুটি সিরিয়াল এবং খণ্ড নাটকের কাজে শুরু করতে যাচ্ছি শিগগির।
জাগো নিউজ : চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কিছু বলুন...
বাবলু : মামুন স্যারের ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’ ছবির সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। এছাড়া উনার ‘দুই বিয়াইয়ের কীর্তি’ ছবিতেও আমি সহকারি ছিলাম। নিজেকে অনেকটা প্রস্তুত করেছি চলচ্চিত্র নির্মাণে। ইচ্ছা আছে বড় পর্দায় কাজ করার। বেশ কিছু গল্পও বাছাই করেছি। সেগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। ব্যাটে বলে মিলে গেলে যে কোনো সময় চলচ্চিত্র নির্মাণে নেমে যাবো।
এনই/এলএ