ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

বিতর্কের মুখে হায়দার হোসেনের স্বাধীনতা গান!

প্রকাশিত: ১০:৫৮ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫

দীর্ঘদিন ধরেই সংগীতের চর্চা করে আসছিলেন কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন। ২০০১ সালের দিকে ‘কি দেখার কথা কি দেখছি/কি শোনার কথা কি শুনছি…/৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি-’ বাস্তবধর্মী এমন কথার গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পান তিনি। গানটিতে কণ্ঠ দেয়ার পাশপাশি এটির লেখা ও সুরও করেছেন তিনি।

প্রায় দেড় দশক পর এই গানটি নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়েছে। আর সেই বিতর্কের সূত্রপাত জনপ্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ফেসবুক স্ট্যাটাস। ‘স্বাধীনতা’ গানটির প্রতিটি লাইন মূলত প্রশ্নবোধক। রিটন সেই প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা দিয়ে হায়দার হোসেনের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি পোস্ট করেছেন।

স্ট্যাটাসটি এরইমধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে অনলাইনে। প্রায় দুই শ’ বারের মতো এটি শেয়ার করা হয়েছে ফেসবুকে। মন্তব্য করেছেন অনেকেই। রিটনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মন্তব্যকারীদের অনেকেই বলেছেন, গানটি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পক্ষের বক্তব্য এবং গানটিতে সুক্ষ্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য’ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন- রিটন আজকে যা ভাবছেন সেটি তারাও ভেবেছিলেন অনেক আগে। কিন্তু একজন জনপ্রিয় শিল্পীর গান বলে এ নিয়ে উচ্যবাচ্য করেননি।

অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন রিটনের মতোই- একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বাস করে হায়দার হোসেন কার স্বাধীনতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তবে কি তিনি দেশবিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী জামাতের দৃষ্টিকোণ থেকে এই গান করেছেন?

এদিকে নিজের স্ট্যাটাসে রিটন ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসনের সমর্থনে রেডিওর জন্য গান লিখায় সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব প্রয়াত খান আতারও সমালোচনা করেন। তিনি এ বিষয়ে লেখেন, ‘কিছু মনে করবেন না জনাব হায়দার হোসেন। আপনি তো জানেনই, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভীত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর খান আতা খুঁজেছিলেন `মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য` আর আপনি তিরিশ বছর পর `স্বাধীনতাটাকেই খুঁজতে` নেমেছিলেন!’

দেখা যায় তিনি হায়দারের গাওয়া ৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি- এই লাইনের জবাবে বলেন, ‘আমার খটকা লাগে কেন আপনি (হায়দার হোসেন) তিরিশ বছর পর স্বাধীনতাটাকে খুঁজছেন? ওটা কি হাতছাড়া হয়ে গেছে?

রিটন যা লিখেছেন তার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

অতঃপর আপনি লিখেছেন ‘স্বাধীনতা কি বৈশাখী মেলা, পান্তা ইলিশ খাওয়া?
- জ্বী জনাব, এটা আমরা অর্জন করেছি। এটাকে বন্ধ করতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা ফাটিয়ে হত্যা করেছিলো নিরিহ বাঙালিকে। আমাদের হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতিকে স্তব্ধ করতে ওরা হামলা করেছিলো রমনায় ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে। বৈশাখী মেলার আয়োজন করা, ওখানে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এবং রবিঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি গাইতে পারাই আমার স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি।

‘স্বাধীনতা কি বটমূলে বসে বৈশাখী গান গাওয়া?’
- অবশ্যই। সেই ষাটের দশকে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ হয়েছিলো এই বাংলায়। সেদিন, ওয়াহিদুল হক প্রমূখদের নেতৃত্বে ছায়ানটের ছায়াতলে সমবেত হয়েছিলেন বাঙালির মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তার অগ্রদূতরা। রমনার বটমূলে বসে বৈশাখী গান গাইতে পারার স্বাধীনতাই আমার স্বাধীনতা।

‘স্বাধীনতা কি বুদ্ধিজীবির বক্তৃতা সেমিনার?’
- নিশ্চয়ই। বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা সেমিনার যাতে এইদেশে না হয় সেই জন্যেই তো পরাজয়ের পূর্বাহ্নে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে উঠেছিলো নিজামী-মুজাহিদের রাজাকার আর আলবদর বাহিনি। দেশকে মেধাশূন্য করতেই ভয়ঙ্কর সেই পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন করছিলো ওরা দ্রুত। ১৬ই ডিসেম্বর দেশটি স্বাধীন না হলে নিহত বুদ্ধিজীবীর তালিকাটি আরো দীর্ঘ হতো, সন্দেহ নেই।

‘স্বাধীনতা কি শহীদ বেদিতে পুষ্পের সমাহার?’
- অতি অবশ্যই, একাত্তুরে আমাদের শহীদ বেদি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো পাকি সৈন্যরা। ওখানে ফুল দেয়াকে ধর্মান্ধ ও যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসররা নাজায়েজ মনে করে, এখনও। অধর্মের কাজ বলে মনে করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। অথচ ফুলেলশ্রদ্ধা পৃথিবীব্যাপি স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক রেওয়াজ। শহীদ বেদিতে পুষ্পের সমাহারই প্রমাণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। শহীদ মিনার আমার স্বাধীনতার প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে, ছাব্বিশে মার্চে এবং ষোলই ডিসেম্বরে শহীদ মিনারে স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ আমার স্বাধীনতারই আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ।

‘স্বাধীনতা কি গল্প নাটক উপন্যাস আর কবিতা?’
- জ্বী স্যার, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় সংগীত ছিলো--মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।...নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি...নতুন একটি গানের জন্যে যুদ্ধ করি...স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই গানটি এখনও শিহরণ জাগায় রক্তে। আমি আমার গল্প লিখবো, নাটক লিখবো, উপন্যাস আর কবিতা লিখবো--এটাই তো আমার স্বাধীনতা জনাব! কবি শামসুর রাহমানের পঙ্‌ক্তি এখানে স্মরণযোগ্য--স্বাধীনতা তুমি...যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা...।

Haydar
‘স্বাধীনতা কি আজ বন্দী আনুষ্ঠানিকতা?’
--নাহ। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী নয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আছে বলেই, পেয়েছি বলেই আপনি এই গান গাইতে পারছেন। স্বাধীনতা আছে বলেই আপনার হাতে গীটার। যন্ত্রাণুষঙ্গযোগে আপনি গান গাইছেন। স্বাধীনতা না এলে আপনি হতেন সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য।

‘স্বাধীনতা কি ঢাকা শহরের আকাশচুম্বী বাড়ি?’
--পরাধীন আমলে পূর্ব পাকিস্থানের রাজধানী ঢাকা শহর ছিলো উন্নয়নবঞ্চিত শহর। পশ্চিমারা করাচি-লাহোর-ইসলামাবাদ-পিন্ডির পেছনে যতো ব্যয় করতো তার দশ ভাগের একভাগও ঢাকার পেছনে ব্যয় করতো না। স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে আকাশচুম্বী দালান। যা করাচি-লাহোর-ইসলামাবাদ-পিন্ডিতেও নেই।

এছাড়াও রিটন গানের সব লাইন শেষে লিখেছেন, ‘স্যার আপনার গানে রাজাকারের কথা নেই যে! ঘাতক দালালের কথা? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা কই? এককথায় স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা কোথায়, এই গানে? তিরিশ বছর পরের বাস্তবতায় ‘স্বাধীনতা কি রাজাকারদের মন্ত্রী হবার গল্প’ কিংবা ‘স্বাধীনতা কি খুনির গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড্ডীন’ ধরণের একটি চরণও ঠাঁই পায়নি এই গানে। অথচ সেটা পেতে পারতো। তিরিশ বছর পরের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। এই গানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সুশীল অবস্থান লক্ষ্যণীয় যে অবস্থান আখেরে জামাতিদের পক্ষে চলে যায়।

সবশেষে রিটন হায়দার হোসেনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘প্রিয় হায়দার হোসেন, স্বদেশে এবং বিদেশে বিপুল ভাবে জননন্দিত একজন শিল্পী আপনি। শিক্ষিত রুচিস্নিগ্ধ অমায়িক আচরণসম্পন্ন মার্জিত একজন শিল্পী হিশেবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আপনি একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক, আমি জানি।

আমি জানি এই গানটি লিখবার পেছনে নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, কিছু যুক্তি আছে আপনার। স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরোপুরি সফল হয়নি, সত্যি। ঘরে ঘরে পৌঁঁছানো যায়নি স্বাধীনতার সুফল, এটাও সত্যি। কিন্তু হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতা এটা সত্যি নয়। এমনকি রূপক অর্থেও নয়।

টিভি টকশোতে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে করতে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত কিছু শিক্ষক-অধ্যাপক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী এক পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামাতিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ফেলেন। আমরা তখন অস্তিত্বসংকটে নিপতিত হই। বিষণ্ণ হই। বিপন্ন বোধ করি। আপনার বিখ্যাত এই গানটি প্রায়শঃ আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলে। বিপন্ন করে ফেলে। বিজয়ের মাসে আমি সেই বিষণ্ণতার কথাই জানাতে এসেছি। আমার বিভ্রান্তিসমূহকে ক্ষমা করবেন।

এলএ