প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কিংবদন্তি খান আতা
তিনি সবার কাছে খান আতা বলেই পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ আনিস নামেও চিনতেন। আর তার মা ডাকতেন ‘তারা’ নামে। তবে পুরো নাম খান আতাউর রহমান। নির্মাণ, অভিনেতা, সুরকার, গীতিকার, গায়ক, সংলাপ রচয়িতা, প্রযোজক, সংগীত পরিচালক ও কাহিনীকার হিসেবে তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি।
আজ এই চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্বের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি মৃতুবরণ করেন।
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর গ্রামে ১৯২৮ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন খান আতা। তার বাবার নাম জিয়ারত হোসেন খান, মায়ের নাম যোহরা খাতুন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা জেলা সংগীত প্রতিযোগীতায় খান আতা প্রথম স্থান দখল করেন। তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তখন থেকেই সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতি তার মনে জন্ম নেয় আগ্রহ। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে সেই আগ্রহটিই পরিণত হয় স্বপ্ন আর ইচ্ছায়।
খান আতা ১৯৪৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করেন। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে তিনি পরিবারের এক সদস্যের চোখে পড়ে গেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন।
কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই মেডিকেল ছেড়ে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবারো তার বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে তিনি সেখানে থাকলেন না। এ বছরেই তিনি লন্ডনে ফটোগ্রাফি বিষয়ক একটি বৃত্তি লাভ করেন।
১৯৪৯ সালে আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। এবারো উদ্দেশ্য ছিল একই। এবার তিনি প্রথমে মুম্বাই যান। মুম্বাই গিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, চলচ্চিত্র জগতের আনাচে কানাচে গিয়েছেন। এসময় তিনি জ্যোতি স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান জাল ইরানির শিক্ষানবিশ হেসেব কিছুদিন কাজ করেন।
একসময় ফিরে আসেন ঢাকাতে। নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে ১৯৫৮ সালে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে আনিস নামে নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন। একই নামে ১৯৫৯ সালে এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতেও অভিনয় করেন। তারপর অসংখ্য ছবিতে তিনি অভিনয় করে মুগ্ধ করেছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের। তবে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে শোষিত মানুষের প্রতীক চরিত্রে তার অভিনয় ছিলো অনবদ্য।
খানা আতা পরিচালক হিসেবে নাম লেখান ১৯৬৩ সালে ‘অনেক দিনের চেনা’ দিয়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে তৈরি করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি ঢাকাই ছবিতে কালজয় করেছে।
এরপর মুক্তিযুদ্ধের উপর ১৯৯৪ সালে ‘এখনো অনেক রাত’ নামের একটি ছবি তৈরি শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ছবির কাজ শেষ হয়। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবির ৭টি দৃশ্য কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। এটিই ছিল তার শেষ নির্মিত ছবি।
খান আতা পরিচালিত অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে- রাজা সন্ন্যাসী, নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭), সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮), অরুণ বরুণ কিরনমালা (১৯৬৮), জোয়ার ভাটা (১৯৬৯), মনের মত বউ (১৯৬৯), সুজন সখী (১৯৭৫), দিন যায় কথা থাকে, আরশীনগর ও পরশ পাথর। এছাড়া তিনি ‘কবি জসীম উদ্দীনের জীবনী’, ‘গঙ্গা আমার গঙ্গা’ ও ‘গানের পাখি আব্বাস উদ্দিন’ নামে ৩টি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।
চলচ্চিত্র, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক মিলিয়ে তিনি প্রায় ৫০০ গানের রচিয়তা। গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৬২ সালে ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে কলিম শরাফীর কন্ঠে তিনি উপহার দেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিতে ‘শ্যামল বরণ মেয়েটি’ গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে তিনি ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ শিরোনামের কালজয়ী গানটি লিখেন ও কন্ঠ দেন। ১৯৭০ ও ৮০ এর দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে ‘এ কি সোনার আলোয়’ ও শহনাজ রহমতুল্লাহের কন্ঠে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’র মতো গান।
‘সূর্যস্নান’ ছবির গীতিকার হিসেবে এবং ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে পাকিস্তান ফিল্ম ফেস্টিভালে ১৯৬৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পান।
মুক্তিযুদ্ধেও তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেশাত্মবোধক গান লিখেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করে সাহায্য করেন। এছাড়া তার চলচ্চিত্র ও গানে দেশ ও মানবতার কথা বারে বারে উঠে এসেছে।
এই কিংবদন্তি ১৯৬৮ সালে তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেন প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনকে। খান আতা এবং নিলুফারের ছেলে কণ্ঠশিল্পী আগুন। আর কণ্ঠশিল্পী রোমানা ইসলাম খান আতার দ্বিতীয় স্ত্রী সংগীত শিল্পী মাহবুবা হাসনাতের গর্ভে জন্ম নেন। তারও আগে শার্লি নামক এক ইংরেজ নারীকে প্রথম বিয়ে করেন। সেই সংসারে আমিন নামে এক ছেলে রয়েছে তার।
এই কিংবদন্তির প্রয়াণ দিবসে জাগো নিউজ পরিবারের পক্ষ থেকে রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সূত্র : উইকিপিডিয়া ও অনলাইন
এলএ