ফরীদি ভাইয়ের সেই অট্টহাসি
বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি থেকে
ইতিহাস নয়, স্মৃতিচারণ। স্মৃতি সবসময়ই অম্লান। পুরোনো স্মৃতিগুলো কুয়াশাবৃত হলেও কোনো এক সময় সূর্যকিরণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের স্মৃতিগুলো কেন জানি মধুর লাগে। কারো হয় কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয়, যদি জীবনকে রিউইন্ড করা যেত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখময় জীবনে তা স্থির করে রাখতাম। আমার জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণযুগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় এক বড় ভাইকে দেখতাম চুলে পনী টেইল করতেন। সে সময় ছেলেরা মেয়েদের মতো লম্বা চুল রাখবে তা ভাবাই যেত না। কোনো কোনো বড় ভাই নিজের আদর্শে বিশ্বাস রেখে, তার এই লম্বা চুল রাখা নিয়ে আড়ালে কথা-বার্তা বলতেন। এক বড় ভাই তো আমাকে বলেই ফেললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে নাকি সঙ সাজতে এসেছে? তুমি কিন্তু ওর ধারে কাছেও যাবে না। ছেলে ভালো না’।
যিনি এ কথা বলেছিলেন তাকে আমার মনে পড়ছে না। মনে না পড়লেও বা তার উপদেশে কিছু যায় আসে না। কারণ তখন ভালো-মন্দ বোঝার বয়স আমার হয়েছে। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় কোনো তরুণ যদি মেয়েদের মতো লম্বা চুল রাখে তাতে কার কি? আমি লম্বা চুলওয়ালা বড় ভাইয়ের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে পড়ি।
একদিন সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢাকায় ফিরছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে, দেখি ওই চুলওয়ালা বড় ভাই বসে আছেন। তার পাশের সিট খালি। সুযোগ বুঝে তার পাশেই বসলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়? আমি বললাম, জী। ‘তুমি কোন ডিপার্টমেন্টের? আমাকে তুমি বলায় অবাক হলাম না, কারণ আমরা তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র।
তাছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়রদের সঙ্গে আপনি বলার কোনো চল নাই। আমাদের যে কেউই তুমি বলতে পারেন। আমি বললাম, কেমিস্ট্রি। তিনি বললেন, রসায়ন থেকে রস আয়ন কর তাই তো? বলেই একটা অট্টহাসি দিলেন। কি চমৎকার হাসি! বেশ রসিকও মনে হলো।
তিনি বললেন, ‘আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব-রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। ভাগ্যিস আগাই নাই তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যেত’। আমি বললাম, আগান নাই কেন? বললেন, কারণ দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। হা হা হা বাদ দাও। রোগা পাতলা বড় ভাইটিকে আমার বেশ ভালো লেগে গেল তার প্রাণ খুলে হাসির কারণে।
একেবারেই নির্মল হাসি। তিনি বললেন, ‘আমার নাম হুমায়ুন ফরীদি’। আমি বললাম, ‘ও’। কারণ হুমায়ুন ফরীদি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাড়া তেমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না। আমাকে বললেন, ‘আমার লম্বা চুল নিয়ে তোমাকে কেউ কিছু বলে নাই? আমি একটু অপ্রস্তুত হতেই তিনি বললেন, ‘বলেছে, অবশ্যই বলেছে।
আমি নাটক করি সেজন্য আমাকে এই চুল রাখতে হয়েছে, আর এই চুল নিয়েই সবার সমস্যা। মনে হয় মাথা আমার না, আমার চুল, আমার মাথা সবই তাদের। যত্তসব ফালতু। এবার আমার আগ্রহের পালা, আমি বললাম, ‘আপনাকে তো টিভিতে কখনও দেখি নাই’! তিনি বললেন, ‘মঞ্চনাটক দেখেছ কখনো? বললাম, না দেখি নাই।
তিনি বললেন, ‘আমি মঞ্চে অভিনয় করি, ঢাকা থিয়েটারে। আজ সন্ধ্যায় আমার নাটক আছে বেইলি রোডে মহিলা সমিতিতে। নাম শকুন্তলা। তুমি আসতে পারো, ভালো লাগবে। সেই সঙ্গে মঞ্চ নাটক দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে’।
প্রস্তাব খারাপ না। এ সুযোগে মঞ্চ নাটক দেখা হয়ে যাবে। আমি বললাম, দেখি আগে বাসায় যাই তারপর বুঝতে পারব আসা যাবে কি না। আমরা তখন সিদ্ধেশ্বরীতে থাকতাম। ওখান থেকে বেইলি রোড, পায়ে হাঁটার দূরত্ব। আমার মনে তখন মঞ্চ নাটক দেখার অধীর আগ্রহ। যাত্রা দেখেছি, তবে মঞ্চ নাটক কখনো দেখা হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।
বেইলি রোড দিয়ে অনেক চলাফেরা করেছি, এখানে নাটক হয় জানতাম, অবশ্য নাটকে আমার আগ্রহও ছিল না। আমার আগ্রহ ছিল অভিসার হলে ইংরেজি চলচ্চিত্রে এ অভ্যাস হয়েছিল, নটর ড্যাম কলেজে পড়াকালীন। সব বন্ধু মিলে এক সঙ্গে অভিসার সিনেমা হলে যেতাম।
নতুন নতুন ইংরেজি ছবি মুক্তি পেলে প্রথম শো দেখতেই হবে। ইংরেজি চলচ্চিত্র যখন প্রথম মুক্তি পেত তার টিকিট কাটার দায়িত্ব ছিল বন্ধু নিশাতের ওপর। সে এ কাজটি বেশ ভালো পারতো।
যা হোক, মহিলা সমিতিতে গিয়ে দেখি প্রবেশ দরজায় বেশ ভিড়, লাইন ধরে সবাই অপেক্ষা করছে। আমি ভাবলাম তাহলে টিকিট পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে টিকিট পেলাম, তখনও সব বিক্রি হয়ে যায়নি। অপেক্ষা করছি। আমি লাইনে দাঁড়াতেই প্রবেশের দরজা খুলে দেয়া হলো। ভেতর ঢুকে অপেক্ষা করছি।
নাটক শুরু হলো। বেশ ভালো লাগলো, নাটকে ফরীদি ভাই, তক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। ওখানে একটা অট্টহাসি ছিল তার। অসাধারণ লাগলো তার ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয়। সেই থেকে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। আমার সেই ভাইয়ের উপর বেশ রাগ হচ্ছিলো, এমন একজন গুণী মানুষের সঙ্গে মিশতে মানা করলেন কেন?
লম্বা চুল দেখেই তিনি ধারণা করেছিলেন ছেলেটি ভালো না। পরিবর্তনশীল এ জগতের অনেক পরিবর্তনই আমরা পছন্দ করি না। বর্তমান যুগে ছেলেরা কান ফুটো করে দুল পরছে এ পরিবর্তন তিনি কীভাবে নেবেন!
ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে ওই সময়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক স্মৃতি হয়তো আছে। তবে আমার সঙ্গে স্মৃতিগুলি কিছুটা ব্যতিক্রমী। ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে গেয়েছিল, তার আরেকটা অন্যতম কারণ, আমরা দু’জনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টিমের খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়।
সেবার খেলা পড়েছে যশোরে, সেখানে যাবার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে অনুশীলন চলছিল। আমাদের কাশেম ভাই পেইস বোলার ছিলেন, তার দুর্দান্ত বোলিংয়ে অনুশীলন করতে ভালোমত গিয়ার্স পরে নিতাম। ফরীদি ভাইয়ের কি মনে হলো তিনি প্যাড ছাড়াই কাশেম ভাইয়ের বলে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আমি বললাম সামনে খেলা আপনার এমন রিস্ক নেবার দরকার আছে? কাশেম ভাইয়ের বলের সুইঙের কোনো ঠিক নেই। তিনি কারো কথা শুনলেন না, কাশেম ভাইয়ের প্রথম বলই তার পায়ের টাখনুতে এসে হিট করলো ঠকাস শব্দ করে। মাঠে বালতিতে আমাদের খাবার পানি থাকত। তিনি সাথেসাথেই পা ডুবিয়ে দিলেন বালতির পানিতে।
কিছুক্ষণ পর ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর কোনো এক খেলা পরিচালনা করে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ওই বালতির পানি মগে ভরে এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। আমরা কিছু বলার আগেই ফরীদি ভাই বললেন, যাহ দুষ্টু আমার পা ধোঁয়া পানি খাইছে, তার পরেই তার বিখ্যাত প্রাণ খোলা অট্টহাসি।
ফরীদি ভাই খেলাধুলা করতে পছন্দ করতেন। আমরা হলের সামনে শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। একরাতে খেলায় জুটি হলেন ফরীদি ভাই আর ক্যামিস্ট্রির রেজা ভাই (রেজা ভাই বর্তমানে ন্যাশভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন), প্রতিপক্ষ আমি আর আমার বন্ধু তাশফিকুর রহমান লিটন।
তারা খেলায় হারছেন এবং জেতার জন্য আবার খেলার অনুরোধ করছেন। আমরাও খেলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে আমি বললাম, আপনাদের না কাল স্টেজ নাটক, ঠান্ডায় যদি গলা বসে যায় তাহলে কি হবে? রেজা ভাইয়ের চরিত্র অন্য কেউ হয়তো করতে পারবে কিন্তু আপনার অট্টহাসি কে দেবে। ফরীদি ভাই বললেন ‘এই মিয়া বড় ভাইদের মতো উপদেশ না দিয়ে খেলো’।
বুঝলাম খেলায় হেরে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। আমরাও বেশ টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। লিটন আর আমার মধ্যে ইশারায় কথা হয়ে গেলো, পরপর দুই গেইম হারলাম। এত গেলো রাতের খবর, পরদিনের খবর হলো ফরীদি ভাইয়ের গলা বসে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। তাদের নাটকের অবস্থা কি হয়েছিল আমার মনে নেই।
ফরীদি ভাইয়ের গানের কণ্ঠও বেশ ভালো ছিলো। আমাদের হলের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গেয়ে ওঠলেন, ‘কাজল জলে অতল তলে দোলায় আশা জাগে হৃদয়, কত যে ধীরে বহে মেঘনা’। মনে পড়ে সেদিন গানটি তার কণ্ঠে খুব ভালো লেগেছিল। ফরীদি ভাই সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
আমাদের হলে এক বড় ভাই থাকতেন, তার সঠিক নাম না বলে তার নাম ধরা যাক আবুল। তিনি তার কথায় অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন। সাভার থেকে কিছু ছেলে আমাদের হলে মিষ্টি বিক্রি করতে আসতো, তাদের তিনি বলতে এই সুইটওয়ালা আমাকে একটি হোয়াইট সুইট দাও তো? তার এ ধরনের কথায় আমরা খুব উপভোগ করতাম।
একদিন ডাইনিং হলে খেতে বসেছি, হঠাৎ ফরীদি ভাইয়ের দাঁতে একটি পাথর চাপা পড়লো। তিনি আবুল ভাইকে লক্ষ্য করে বললেন, এই আবুল, প্রব্লেম হ্যাপেন হইছে। আমার টিথের নিচে ব্রিক পড়ে ব্রেক হয়ে গেছে কি করি বলো তো?
তার সঙ্গে স্মৃতি কথা শেষ হবার নয়। তবে তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল যে বছর তার মেয়ে দেবযানীর বিয়ে হলো, কোন সাল তা ঠিক মনে নেই। আমি তখন বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছি। জাহাঙ্গীরনগরে বেড়াতে গিয়ে আমাদের আরেক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মীর আবুল কাশেম ভাইয়ের অফিসে। কাশেম ভাই তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক রিলেশন ডাইরেক্টর।
ঢুকেই দেখি তিনি মুঠোফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে ইশারায় বসতে বলে কিছুক্ষণ পর মুঠোফোন আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি বললাম কে? বললেন, ফরীদি। ওপাশ থেকে ভরাট গলায় ভেসে এলো, কেমন আছো গালিব? দেশ ছাড়লে কেন? আমি খুবই আনন্দিত কণ্ঠে বললাম, কেমন আছেন ফরীদি ভাই! অনেক বছর পর।
বললেন, আমি খুব ব্যস্ত তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো। আর হ্যাঁ শোনো, আগামী (তারিখ বা দিন সঠিক মনে নেই) আমার মেয়ের বিয়ে, ঢাকা ক্লাবে চলে এসো, আমি পরে কার্ড পাঠিয়ে দেব। আমি বললাম, টেলিফোনেই তো বললেন, কার্ড পাঠাতে হবে না। তিনি বললেন, আমি তো এখন শুধুই তোমার ফরীদি ভাই না, আমি সারা বাংলাদেশের, আমার পাঠানো কার্ডের একটা ভ্যালু আছে না? বলেই তার সেই তার বিখ্যাত অট্টহাসি দিলেন। আমার শোনা তার শেষ অট্টহাসি।
এমআরএম/এমকেএইচ