হুমায়ূন আহমেদ থাকুক উন্মুক্ত
আমার ভালো নাম আসাদুজ্জামান। ছোট নাম লিমন। আমাদের বংশে ‘আহমেদ’ উপাধি কারো নেই। কিন্তু আমি আজ ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে লিমন আহমেদ নামে বিনোদন সাংবাদিকতা করছি। বিভিন্ন পত্রত্রিকায় লিখছি, লিখছি নাটক-কবিতা-গল্প ও গান। যদিও সংখ্যায় তারা সামান্য আর প্রচারে বিকলাঙ্গই। তবুও লিখছি। কিভাবে? হুমায়ূন আহমেদ-এর কারণে।
একটু খুলেই বলি তবে। এই মানুষটির লেখা-কর্ম-জীবন এতটাই মুগ্ধ করেছিলো কৈশরে, তখনই ভেবেছিলাম লেখালেখি করবো। আর অবশ্যই হুমায়ূন আহমেদের মতো। কাছের মানুষদের অনেকেই হাসাহাসি করেছে নামের শেষে আহমেদ লাগানোতে। কী এলো গেলো তাতে! হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আমার ভালোবাসাটাই বড় কথা। সেই ভালোবাসাটাকে আমি জয় করেছি এটাই আমার বড় সার্থকতা।
হুমায়ূন আহমেদ গাছে ধরে না। তার মতো হওয়া যায় না। হ্যাঁ, ভাগ্যে থাকলে হয়তো তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তার মতো হওয়া যায় না। আমি স্বপ্ন দেখি প্রিয় মানুষটির জুতোয় পা গলানোর। অনেক টানপোড়েন আমার জীবনের অলিতে গলিতে। তবুও কোন বিষণ্ন ক্ষণে কিংবা একাকীত্বের রাতে আমি তার জুতো পায়ে দেই। হিমুর সাথে হাঁটি, মিসির আলীর সাথে যুক্তি তক্কে ঝগড়া করি। রুপার অপার্থিব প্রেমে নি:স্ব হই, মারিয়ার স্বর্গীয় চোখের দিকে তাকিয়ে তার হাতে তুলে দেই সব কয়টি নীলপদ্ম আমার।
আমার প্রিয় লেখক আমার প্রেমিক। তিনি আমাকে কৈশোরের বিড়ম্বনার দিনে ভালোবেসেছেন, আজো ভালো বাসছেন। এ ভালোবাসা চিরকাল রইবে এই আমার বিশ্বাস।
হুমায়ূন আহমেদের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। অন্য প্রকাশের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান অন্যমেলায় আমি বেশ কিছুদিন কাজ করেছি ২০০৮ সালের দিকে। হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই আসতেন অন্যপ্রকাশের অফিসে। তাকে দেখেছি। পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। কিন্তু তার প্রতি ‘দেবদাস’ মার্কা ভালোবাসাটা প্রকাশ করিনি। সেটা প্রকাশ হয়েছে ২০১১ সালের ৪ মার্চ।
ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে অন্য প্রকাশের বইমেলায়। সেবারের একুশে বইমেলায় লেখকের ‘বাদশাহ নামদার’ বইটি প্রকাশ হয়েছিলো। টাকার অভাবে কিনতে পারিনি। বইটি কিনেছিলাম ৪ মার্চ। ওখানে হুমায়ূন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বই কিনলেই অটোগ্রাফ পাওয়া যাচ্ছে। তাই এক বন্ধুকে ফোন করে আনিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বইটি কিনেছিলাম। সেদিন অটোগ্রাফ নিয়েছি। সালাম করতে যেতেই তিনি জানতে চাইলেন- কী করি। জানালাম দৈনিক ইত্তেফাকে বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি। মনে হলো খুব খুশি হলেন। জানতে চাইলেন বাড়ি কোথায়? বললাম কিশোরগঞ্জ। শুনে নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘লেগে থেকো। শিল্প সংস্কৃতিতে আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহ বড় পয়া অঞ্চল।’
মুচকি হেসে বেরিয়ে এলাম ভিড় ঠেলে। তারপর বেশ কিছু অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। কথা হয়নি আর। সর্বশেষ বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে। তিনি তখন খুব অসুস্থ। এসেছিলেন তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র প্রিমিয়ারে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো বুকটা। বেঁচে আছেন, তবু তিনি নিষ্প্রাণ। যা করছেন-বলছেন সবই যেন জোর করে। না, এ কোনোদিন ভাবতে চাইনি তিনি চলে যাবেন। আজো ভাবি না তিনি চলে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদরা কোনদিন যান না। থেকে যান হৃদয়ের খুব গভীরে। আজন্মকাল। ঠিক ঋত্বিক ঘটকের নীতার মতো মেঘে ঢাকা তারা হয়ে। তাকে শ্রাবণ মেঘের দিনে পাওয়া যায় না বটে, দুই দুয়ারী মনের অনুভূতিতে তিনি দেখা দেন নিয়মিতই। যখন আমি একা; কোথাও আমার কেউ নেই।
খুব কষ্ট পাই একদল ভ্রষ্ট সাহিত্যিক-সাহিত্য সমালোচকদের মুর্খতাসুলভ কথাবার্তায়। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সমালোচনা করেন। তারা মুখে লাগাম রাখেন না হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথা বলতে। তাদের দাবি এই লেখকের লেখায় জীবন নেই, বাস্তবতা নেই, লজিক নেই। তার সব লেখাই হালকা। এ যে কতোবড় অপবাদ তা যারা অনুধাবণ না করতে পারবেন, তাদের বোঝানো অসম্ভব। এইসব কথার আসলে কোনো যুক্তিকথা নেই। এইসব কথা বলা হয় সম্পূর্ণই ঈর্ষাকাতর হয়ে, হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে। হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিক হিংসার শিকার হবেন এটা বালকেরও বোধগম্য।
যারা তার সাহিত্যের অনুরাগী তারাই জানেন, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের জীবনমুখিতা, ওজন, গুরুত্ব নোবেল পাওয়ার মতোই যোগ্যতা রাখে। অনেকে আবার লেখকের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সমালোচনায় পেরে না ওঠে হানা দেন তার ব্যক্তিগত জীবনে। তাদের উদ্দেশ্যে অনেক কথাই মুখে আসে। তবে অতো কথায় না গিয়ে বলতে চাই- ‘যখন কেউ বলে চাঁদের পূর্ণিমা ভালো লাগে না, ধরে নিতে হয় সে অন্ধ। তার মতো অভাগা আর কেউ নয়........’
গেল বছর পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের কিংবদন্তি চরিত্র হিমুকে নিয়ে সিনেমা বানাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলকাতার স্বনামধণ্য পরিচালক রাজ চন্দ্র। এটা খুবই বেদনার, আমাদের দেশে এতোসব পন্ডিত আর স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী চিত্র নির্মাতা থাকতেও হুমায়ূন আহমেদের হিমু নিয়ে কাজ করতে সর্বপ্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো ভারতের একজন নির্মাতা!
যাই হোক, হিমুর চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিলো বলিউডের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অভিনেতা ইরফান খান। হিমুর চরিত্রায়ণে এই অভিনেতা হিমুকে বাংলা ভাষার গন্ডি ছাড়িয়ে বহুভাষার মানুষের মাঝে নিয়ে যাবেন সেই প্রত্যাশায় মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিলো। কিন্তু সেই ছবির কাজ আর এগুয়োনি হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের আপত্তিতে। তিনি হিমুকে নিয়ে ছবি বানাতে দিতে রাজি হননি। এটা হিমু ভক্তদের জন্য বেদনার তো বটেই, হুমায়ূন আহমেদের জন্যই কষ্টের।
আপত্তি করার অধিকার শাওনের আছে। তবে হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে আমাদেরও নিশ্চয় কিছু বলার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকে বলছি হুমায়ূন আহমেদের লেখাগুলো যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বহু ভাষায় প্রকাশ করা যেতো তবে বাংলা সাহিত্যের ভাগ্যে অনেক প্রাপ্তি জুটত। সেটি তো হয়নি পরিতাপের বিষয়; কিন্তু তা যদি চলচ্চিত্র দিয়ে হয় তবে কেন আপত্তি করা? ভালো নির্মতাকে অবশ্যই শাওনের সাহায্য করা উচিত হিমুসহ হুমায়ূন আহমেদের সকল সৃষ্টি নিয়ে কাজ করতে। আর নির্মাতা বিদেশি হলে, ভিনদেশি ভাষার হলে তো কথাই নেই।
এই ভারতবর্ষে মানুষের কাছে শরৎচন্দ্র আর রবি ঠাকুরের জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে তাদের সাহিত্য নিয়ে নাটক-টেলিফিল্ম-তথ্যচিত্র-চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ায়। আমরা চাই হুমায়ূন আহমেদের বেলাতেও সেটা হোক, অবাধে। হুমায়ূন আহমেদ ও তার সাহিত্য সবার হোক, উম্মুক্ত। আমরা প্রিয় লেখককে সার্বজনীন দেখতে চাই। ভালো মন্দ বিচারের দায়িত্ব পাঠকের-দর্শকের।
আজ ১৩ নভেম্বর। জননন্দিত কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। কতোতম জন্মদিন সে হিসেবে যাবো না। যাকে চিরকাল মানুষ ভালোবাসবে তাকে সময়ের ফ্রেমে বন্দী করা কেন? এ দেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে হুমায়ূন আহমেদের প্রচেষ্টা ছিলো অসীম। তাই তার জন্মদিন, মৃত্যুদিনের বিস্তৃতি-গুরুত্ব আমাদের কাছে অসীমেরও অজানা। চোখের দেখায় তিনি নেই। তার এই না থাকা চোখকে কাঁদায়, প্রাণকে নয়। চোখের আড়ালে গিয়ে তিনি চিরদিনের মতো ঠাঁই করে নিয়েছেন প্রাণের গহীনে। জানি না সেখানে কেমন আছেন। তবে তার ভালোবাসায় আমরা ভালো আছি, আমি ভালো আছি।
সেই বিশ্বাস থেকে দাবি করছি, আমাদের হুমায়ূন আহমেদও ভালো আছেন নিশ্চয়। তাকে পেয়েছিলাম অগ্রজদের হাত ধরে, তিনি আছেন আমার ও তার অন্তরেও। এভাবেই ভালোবাসার ওয়ারিশ দিয়ে যাবো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
এলএ/এমএস