দৃষ্টির সীমানার ওপারে চিরনিদ্রায় আলাউদ্দিন আলী
স্বজন-সহকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দুই দফা জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হলেন বরেণ্য গীতিকার ও সুরকার আলাউদ্দিন আলী। আজ (১০ আগস্ট) বিকাল সাড়ে ৪টায় মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে তাকে। চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে চিরদিনের মতো দৃষ্টির সীমানার ওপারে চলে গেলেন তিনি।
এর আগে আজ দুপুর সোয়া ২টার দিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিএফডিসিতে নেওয়া হয় আলাউদ্দিন আলীর মরদেহ। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ আসে কবরস্থানে। করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে অল্প লোকের উপস্থিতিতে কিংবদন্তি সুরস্রষ্টার দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান আলাউদ্দিন আলীর জামাতা কাজী ফায়সাল আহমেদ।
গতকাল রোববার (০৯ আগস্ট) বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে রাজধানী মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আলাউদ্দিন আলী। এরপর রাতে তার মরদেহ রাখা হয় বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে।
সোমবার সকালে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার বনশ্রীর বাসায়। সেখানে বিটিভির সহকর্মী ও এলাকাবাসীর জন্য তাকে রাখা হয় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১২টা অবধি। এরপর নেওয়া হয় খিলগাঁওয়ে আলাউদ্দিন আলীর আদি বাড়িতে। সেখানে তাকে শেষবার দেখেন শিল্পীর প্রথম স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও অন্য স্বজনরা।
বাদ জোহর খিলগাঁও তালতলা মোড়ে নূর-এ-বাগ জামে মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জানাজা শেষে আলাউদ্দিন আলীকে শেষবারের মতো এফডিসিতে আনা হয়। সেখানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, ডিরেক্টরস গিল্ড, চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানানোর পর এফডিসিতে আলাউদ্দিন আলীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে জানাজা শেষেই সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। হাজার হাজার গান দিয়ে শ্রোতাদের মন জাগিয়ে রাখা জাদুকর এখানেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন।
প্রসঙ্গত, সংগীতে আলাউদ্দিন আলী প্রথম হাতেখড়ি বেহালায়, ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে। ছোটবেলাতেই বেহালা বাজানোর জন্য ‘অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায়’ পুরস্কার পান ঢাকার এ শিল্পী।
১৯৬৮ সালে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে বেহালাবাদক হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজসহ বিভিন্ন সুরকারের সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বেহালা বাজাতে গিয়ে সংগীত পরিচালনার উপর আগ্রহ সৃষ্টি হয় এই সংগীত পরিচালকের। ১৯৭২ সালে দেশাত্মবোধক গান ‘ও আমার বাংলা মা’ গানের মাধ্যমে জীবনে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার।
তারপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করলে একই বছর ‘সন্ধিক্ষণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম সিনেমাতে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন তিনি। তিনি ১৯৭৫ সালে সংগীত পরিচালনা করে বেশ প্রশংসিত হন। খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও তিনি গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৯), সুন্দরী (১৯৮০), কসাই এবং যোগাযোগ চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালনা করেছেন।
সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০টিরও অধিক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে পাঁচবার, শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে একবার এবং সেরা সুরকার হিসেবে একবার, মোট ৭টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন আলাউদ্দিন আলী। এছাড়াও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভূষিত হয়েছেন নানান সম্মাননা ও স্বীকৃতিতে।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের বহু নন্দিত কণ্ঠশিল্পী তার সুরে গান করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন।
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়সহ একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, ইস্টিশনের রেলগাড়িটা, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, হয় যদি বদনাম হোক আরো, ও আমার বাংলা মা তোর, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি, সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ, বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না, যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে, এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়, সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে, আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা, শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে, তোমাকে চাই আমি আরও কাছে, এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না, পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’র মতো শ্রোতাপ্রিয় সব গান তিনি রেখে গেছেন কোটি শ্রোতার জন্য।
এলএ/এমএস