ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত সময় চলছে : ফেরদৌস
বেশ কিছু অভিযোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ১৮ সংগঠন। এদিকে মিশা ও জায়েদকে সমর্থন দিয়ে উল্টো ১৮ সংগঠনকেই বয়কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিল্পী সমিতির নেতা ডিপজল, রুবেলসহ আরও কয়েকজন। সে নিয়ে জল ঘোলা হয়েই যাচ্ছে সিনেমাপাড়ায়।
১৮ সংগঠনের বাইরে নিজেদের সংগঠনেও বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন মিশা ও জায়েদ। ১৮৪ জন শিল্পী তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার অভিযোগ এনেছেন জায়েদ খান ও তার সভাপতি মিশার বিরুদ্ধে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তারা এফডিসির সামনে মানববন্ধন করেছেন, দুই নেতার পদত্যাগও দাবি করেছেন। বিশেষ করে জায়েদ খানের বিরুদ্ধে শিল্পী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
সবকিছু মিলিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যে সংকটময় অবস্থা দেখা দিয়েছে তাকে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করলেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘এর আগেও বহুবার বহু ঝামেলা ইন্ডাস্ট্রিতে হয়েছে। একসঙ্গে চলতে গেলে নয়দিন ভালো যাবে একদিন খারাপ যাবে। এটাই স্বাভাব্কি। বিভিন্ন সময় অনেক প্রযোজক-পরিচালকের সঙ্গে শিল্পীদের ঝামেলা হয়েছে, সেগুলো মিটমাটও হয়েছে। শিল্পী সমিতির মধ্যেও ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা কখনো হয়নি। প্রথমবারের মতো শিল্পী সমিতির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন নেমেছে সদস্যরা। করোনার মধ্যেও মৃত্যুর পরোয়া না করে তারা রাস্তায় নেমেছে কি এমনি এমনি? অবশ্যই তীব্র ক্ষোভ রয়েছে তাদের। শিল্পী সমিতির ইমেজ, গুরুত্ব বিবেচনা করে এই বিষয়টা কিন্তু ভয়াবহ। চরম লজ্জার। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত সময় চলছে।’
ফেরদৌস বলেন, ‘আমি কখনোই এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইনি। আমি মনে করি উপরে থুথু দিলে নিজের গায়েই পড়ে। সিনেমার একটা বাজে লোককে নিয়ে কথা বললেও সেটা কিছুটা হলেও আমাকে ছোট করবে। তাই চুপ থাকতে চেয়েছি। কিন্তু যে অবস্থা দেখছি তাতে আসলে চুপ করে থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ’
হঠাৎ বৃষ্টি’খ্যাত এই নায়ক আরও বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি সবসময় সিনেমায় মনযোগী থাকতে। দুই বাংলায় সমানতালে কাজ করে গিয়েছি অনেকটা লম্বা সময়। কখনো ফিল্মের পলিটিক্সে জড়াইতে চাইনি। কিন্তু ২০১৭ সালে আমার অনেক সিনেমার নায়িকা মৌসুমীর প্যানেল থেকে নির্বাচনে এসেছিলাম। রিয়াজ, পপি, পূর্ণিমাসহ অনেককেই দেখেছিলাম সে বছর। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ ছিলো। কিন্তু নির্বাচনের পরই দেখলাম সবকিছু স্বার্থের খেলা। জায়েদ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবাদ করেও তাকে ফেরানো যায়নি। মিশা ভাইয়ের মতো লোক তাকে অন্ধের মতো সমর্থন দিয়েছেন। তিনি আপাদমস্তক শিল্পী। তার একটা সুনাম আছে। তাকে মানায় না।
তাকে নিয়েই অন্যায়ভাবে জায়েদ ১৮৪ জন শিল্পীকে বাদ দিয়েছে। আমি বলেছিলাম যদি এইসব শিল্পীরা অবৈধও হয় তবুও যেন এদের শাস্তি না দেয়া হয়। কারণ এখানে অনেক শিল্পী রয়েছেন যারা আমাদেরও অনেক সিনিয়র। তাদেরও একটা সম্মান আছে কিন্তু। একটা অধিকার আছে এই সমিতির প্রতি। এদের অধিকাংশই আর্থিকভাবে তেমন খুব একটা কিছু পায়নি। নাম-খ্যাতিও হয়নি। শিল্পী সমিতির সদস্যপদটাকে তারা গর্বের সাথে নেয়। থাকুক, বাতিল করার দরকার নেই।
বরং শাস্তির আওতায় আনা হোক তাদেরকে যারা এইসব শিল্পীদের নিয়ম না মেনে সদস্যপদ দিয়েছিলো। জায়েদ আমার এই কথাটা শুনলো না। সে তার ইচ্ছেমতো যাকে খুশি বাদ দিয়েছে। আবার নিজের মতো করে অনেককেই সদস্যপদ দিয়েছে। এখান থেকেই বোঝা যায় পুরো ব্যাপারটা পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক। কারণ যে দোষে তুমি অন্যদের বাতিল করলে তারচেয়ে বড় দোষ থাকা সত্বেও আরেকজনকে তুমি যোগ করে নিয়েছো! সে বলে ফারুক ভাই, সোহেল রানা ভাই, ইলিয়াস কাঞ্চন ভাইসহ কয়েকজন সিনিয়ররা এটা করেছেন। ভুল। এনাদেরকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এনাদের নামেও ভুল কথা ছড়ানো হয়েছে। মিশা ভাই সব জেনে বুঝেও চুপ ছিলেন।
শুধু তাই নয়, মিশা ভাইয়ের মতো একজন শিল্পী থাকতেও জায়েদ টাকা পয়সা নিয়ে আমাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে। দিনের পর দিন আমি, রিয়াজ, পপি, পূর্ণিমাসহ আরও অনেকেই বিনামূল্যে পারফর্ম করে শিল্পী সমিতিরি তহবিলে টাকা জমিয়েছি। শত শত দিনমজুর শিল্পীরাও এর সঙ্গে জড়িত। যখনই টাকার হিসেব চাইলাম তারা উল্টা পাল্টা বলতে শুরু করলো। তারা বলে আমাদের টাকা দিয়েছে। আমাকে নাকি ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। আমার কথা হলো আমি কি ৫০ হাজার টাকার শিল্পী? রিয়াজ-পপি, পূর্ণিমারা ৫০ হাজার টাকার শিল্পী? জায়েদ খান কী করে এই কথা বলে!
মিশা ভাই থাকতেও এফডিসিতে শিল্পী সমিতির প্রোগ্রাম থেকে রিয়াজের মতো জনপ্রিয় একজন শিল্পীকে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। তাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। কেন? কার স্বার্থে? এগুলো কিন্তু হতাশাজনক। তারা চায় না কেউ কথা বলুক। এভাবে তো সমিতি চলতে পারে না।
শিল্পীদের এই সমিতির মূল কাজ হলো শিল্পীদের দেখভাল করা। কিন্তু এখানে হচ্ছে টা কী? কেউ তো এটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতে পারেন না। একজন মানুষ সারাদিন এখানে অফিস করেন। রাত নিশুতি হলেও সে চেনা নেই জানা নেই লোকজন নিয়ে এখানে আড্ডা দেয়। এগুলো কী? তার বিরুদ্ধে কান পাতলেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। কেন? আর সবই কি মিথ্যে? আমার কথা হলো যদি কোনো দোষ না থাকতো তাহলে তার পদত্যাগ নিয়ে এত সরব হতো না সবাই। ১৮টি সংগঠনের মানুষের এক হওয়া কিন্তু যা তা ব্যাপার নয়। সেটাও করোনার এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে। অন্যায় হয়েছে বলেই শাস্তির দাবি উঠেছে। অনেকে বলছে ১৮ সংগঠনকেই বয়কট করে দেবে এদের বয়কট করলে। এগুলো হাস্যকর। বলার জন্য বলা। প্রযোজক-পরিচালক সমিতিগুলো আমাদের মাদার সংগঠন। তারা আমাদের সমিতি কিন্তু বয়কট করেনি। দুজন অন্যায়কারীকে, অভিযুক্তকে অবাঞ্ছিত করেছে। তারা যদি পারে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে তবে করুক। শিল্পী হিসেবে সবাই তাদের পাশে থাকবো। কিন্তু আবেগে অন্যায়কারীকে সমর্থন দেয়াটা ঠিক নয়।’
সিনিয়রদের প্রসঙ্গ টেনে ফেরদৌস বলেন, ‘আজ যখন শিল্পীদের দুজন নেতার পদত্যাগ বা বয়কটের দাবি উঠছে তখন আমাদের কয়েকজন সিনিয়র তাদের হয়ে কথা বলছেন। সিনিয়রদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যদি তারা ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতেন আমিও সমর্থন করতাম।
কিন্তু এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এই দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো। তাহলে কেন তারা তাদের জন্য কথা বলে নিজেদের ছোট করছেন, শিল্পীদের ছোট করছেন, সমিতিকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলছেন? কিছুদিন আগে যখন ইন্ডাস্ট্রি ডমিনেটিং করা একজন সুপারস্টারকে বয়কট করা হয়েছিলো তখন তারা বলেননি যে শিল্পীদের কখনো বয়কট করা যায় না! নাম নিয়েই বলছি, শাকিব খানকে বয়কট করা হয়েছিলো চলচ্চিত্র পরিবার থেকে। পুরো চলচ্চিত্র পরিবার মনে করেছিলো শাকিবের অন্যায় হয়েছে। তাকে শাস্তি দেয়া উচিত। তাই বয়কট করা হয়েছিলো। শাকিবও সেটা মেনে নিয়েছিলো। একপর্যায়ে সে এফডিসিতে এসে সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করেছে। সরিও বলেছে।
তাহলে এখন কেন অন্য কথা বলা হচ্ছে আমার মাথায় ঢুকছে না আসলে। আমি সবাইকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করবো। যদি ইন্ডাস্ট্রি ভালো রাখতে হয়, স্বাভাবিক রাখতে হয় তাহলে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সমাধান করতেই হবে। যে অভিযোগগুলো উঠছে সেগুলো খতিয়ে দেখুন। সেগুলোর তথ্য প্রমাণ যাচাই করুন। অন্যায়কারীকে সমর্থন দেয়াও তো অন্যায়। আমরা পরিবার থেকে এটা শিখিনি যে অন্যায়কারীকে সমর্থন করো। সিনিয়রদের কাছ থেকেও শিখতে চাই না। আপনারা সব সমস্যার সমাধান করে ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করুন।’
‘যে শিল্পী নয় সেই কেবল শিল্পীদের অপমান করতে পারে। একজন শিল্পী কী করে তার পরিবারের লোকদের দুঃস্থ বলে। কোনো ভাইয়ের বোন যদি গরীবও হয় সেই ভাই নিরবে বোনকে সাহায্য করে। সবার সামনে ভালো আছে দেখাতে চায়। কিন্তু আমাদের সমিতিতে চলে দুঃস্থ বানানোর উৎসব। কাউকে এক পয়সা দিলেই সেটা নিয়ে প্রচার শুরু হয়ে যায়। এটা অত্যন্ত বাজে অবস্থার জন্ম দিয়েছে। শিল্পীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটা গোপন প্রেম থাকে সেইটা নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ এখন ফেসবুক খুললেই দেখছে শিল্পীরা সব না খাওয়া। সবাই দুঃস্থ। এদের জন্য কে প্রেম দেখাবে। এটা ঠিক হয়ন ‘- যোগ করেন ফেরদৌস।
মিশা ও জায়েদকে কোনো পরামর্শ দেবেন কী না জানতে চাইলে ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার পরামর্শ দেয়ার কিছু নেই। আমি কেবল আমার নিজের উপলব্দির কথা বলতে পারি। যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তাদের দুজনকে নিয়ে আমি তাদের জায়গায় থাকলে অবশ্যই পদত্যাগ করতাম। আমার বিরুদ্ধে লোকজন আন্দোলন করে রাস্তায় নেমেছে তার মানে বিষয়টা আর আলোচনার পর্যায়ে নেই। এটা তো খুবই লজ্জার। যার আত্মসম্মানবোধ আছে সেই সরে যাবে। যারা তোমাকে একদিন এই জায়গায় এনেছিলো, নির্বাচিত করেছিলো, সমর্থন দিয়েছিলো তারাই আজ তোমাকে চাইছে না। কেন চাইছে না? তুমি ব্যর্থ বলেই কিন্তু চাইছে না। তোমার সঙ্গে এখানে কারো জমি নিয়ে বিরোধ নেই। বিরোধটা আদর্শের, ন্যায়ের, নীতির। এটা উপলব্দি করে সরে যাওয়া উচিত। আমি মনে করি, একজন শিল্পীর জন্য ক্ষমতার চেয়েও বেশি জরুরি আত্মসম্মানবোধ থাকা।
আমি মিশা ভাইকে বিচক্ষণ ও বিবেচক মানুষ হিসেবেই জানি। তিনি আপাদমস্তক একজন শিল্পী। অন্যদের মতো পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার দরকার নেই তার। তাই মিশা ভাইকে বলবো একজন শিল্পী হিসেবে আপনাকে সমালোচিত দেখতে চাই না।’
শেষবেলায় ফেরদৌস বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিটা আমাদের জন্য রেখে গেছেন সেই স্বপ্ন পূরণে সবাইকে কাজ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমা নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক একজন মানুষ। তিনি চান আমরা আবারও সোনালি দিনগুলো ফিরিয়ে আনি। কিন্তু কিছুতেই কেন হচ্ছে না সেগুলো ভাবতে হবে। যোগ্য মানুষ, যোগ্য নেতৃত্বের হাতে ঢাকাই সিনেমাকে ছাড়তে হবে। আমি বিশ্বাস করি এই আঁধার কেটে যাবেই। এই সংকটময় কলঙ্কিত সময়টা থাকবে না।’
এলএ/এমকেএইচ