ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

আমার অনুপ্রেরণা লাকি আর হ্যাপি আখন্দ

প্রকাশিত: ০৮:৩১ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

তার অনেক পরিচয় দেয়া যায়। তবে তার অমর সৃষ্টি বাসু চ্যাটার্জির চলচ্চিত্র ‘হঠাৎ বৃষ্টি’তে সংগীত পরিচালনায়। তার সুর-সংগীতেই এই ছবিতে গান করে আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন জীবনমুখী গানের কিংবদন্তি গায়ক নচিকেতা। বলছি বরেণ্য সংগীত পরিচালক মধু মুখার্জির কথা। তিনি বাংলা গান ভালোবাসেন, বাংলাদেশ ভালোবাসেন। হৃদয়ে লালন করেন এদেশের শিল্পীদের সংগীতের মানুষ, সুর ও আদর্শ। কলকাতার বেচুলাল রোড পদ্মপুকুরের বাসায় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এই গান পাগলের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের সংগীতে পরিচিত মুখ রিপন চৌধুরী-

কে মধু?
কলকাতার কাছে হাওড়া জেলার লিলুয়াতে সম্ভ্রান্ত মুখার্জি পরিবারে জন্ম নেয়া এই মানুষটি ছোট বেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন। সংগীত ব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরীর সাথে সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন। আশা ভোঁসলের নজরুল সংগীত, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, উষা উত্থুপ, ইন্দ্রানী সেন, মিতালী মুখার্জি প্রমুখের অ্যালবামে সংগীত পরিচালনা করেন। আবিস্কার করেন নচিকেতা ও শিলাজিতের মতো অসাধারণ প্রতিভাদের।

তিনি কাজ করেছেন আনন্দ শংকরের অর্কেষ্ট্রা দলে। বাংলাদেশের আলাউদ্দিন আলির কলকাতায় যত সংগীত ধারণের কাজ হয়েছে প্রায় সব ক’টিতেই তিনি কাজ করেছেন। বাজিয়েছেন রুনা লায়লার গানেও। হিন্দি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করলেও শেষ পর্যন্ত বোম্বের সংগীত ছেড়ে তিনি বাংলার টানে কলকাতায় আবার ফিরে আসেন। পদক আর সম্মাননার ঝুলিতে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৬ সালে পশ্চিম বাংলার ‘বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ পদক ও শিলাজিতের অ্যালবামের জন্য ‘গোল্ডেন ডিস্ক ও প্লাটিনাম ডিস্ক’ পদক প্রাপ্ত হন। বর্তমানে বাংলা ফিল্মের সংগীত পরিচালনার কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বরেণ্য সংগীত ব্যক্তিত্ব মধু মুখার্জি।

শুরু আর অনুপ্রেরণার কথা
‘খুব ছোট বেলা থেকেই সংগীতের সাথে আমার পরিচয়। আমরা দাদা ভালো সেতার বাজাতেন। বাবা-মা নাটকে অভিনয় করতেন। প্রকৃত অর্থে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা’- বলেন মধু মুখার্জি। তার শুরুটা হয় তবলা দিয়ে। পন্ডিত কিশোরী মোহন প্রামাণিকের কাছে তাঁর হাতে খড়ি। একটু বড় হবার পর স্টিল গিটার (হাওয়াইন গিটার) শেখা শুরু করেন শ্রী সৌমেন মুখার্জীর কাছে। পরবর্তী সময়ে স্কুল জীবনের শেষ দিকে বাংলাদেশের লাকি আখন্দ ও হ্যাপি আখন্দের সাথে পরিচয় ঘটে পশ্চিম বঙ্গের দূর্গাপুরের একটি অনুষ্ঠানে। তাদের গিটার বাদন ও গানে মুগ্ধ হয়ে যান মধু মুখার্জি। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মৃতি চারণ করে বলেন, ‘স্প্যানিশ গিটার শেখার ব্যাপারে হ্যাপির অবদান আমি ভুলব না কোনোদিনও। আমার সারা জীবনের অনুপ্রেরণা লাকি আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ। তাদের সংগীতের গভীরতা আমাকে এতটাই বেশি টেনেছে যে, সে সময় আমি তাদের সাথে গৃহত্যাগী হতেও দ্বিধা করিনি। হয়তো সেটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট। পথ চলা শুরু, যা আজো থেমে নেই। আমি শুনেছি লাকি আখন্দ আজ অসুস্থ। উনার সম্পূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি। আরো অনেকদিন তার গানের জন্য বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আরেকজনের নাম আমাকে উল্লে­খ করতেই হবে তিনি আলাউদ্দিন আলি। যার সাথে আমি প্রচুর কাজ করেছি, আর সংগীত সৃষ্টির বৈচিত্রে মোহিত হয়ে গেছি। প্রেরণার কথা বলতে গিয়ে মধু  মুখার্জি বলেন, ‘ভারতীয় সংগীতে পঞ্চম দা’র (আর.ডি.বর্মন) আবর্ত থেকে এখনো মনে হয় কেউ বের হতে পারেনি, আমার ভিতরেও তিনি বাস করেন। স্ট্রিং, বিটলস, জোয়ান বায়াজ এদের গানও আমাকে অনুপ্রাণিত করে। একটা সময়ে আমি ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ মতবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ি। সে সময়টাতেও সংগীত সৃষ্টির অনেক ক্ষেত্র আমি পেয়েছি।’

বাংলাদেশের গান
‘দু’বাংলার লোক সংগীত বড়ই শক্তিশালী এ কথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। তারপরও আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের লোকগান সোঁদা মাটির গন্ধের মতই বিশুদ্ধতায় ভরা, মাটি ও মানুষের সাথে মাখামাখির মতই সহবস্থান করে। ফলে লোক গানের খোজ রাখি আমি’- বললেন মধু মুখার্জী। রুনা আপার (রুনা লায়লা) গান আমাকে ভালো গান তৈরি তাগিদ দেয়। প্রায়ই কষ্ট হয় ভাবতে বাংলা কী করে দুই বাংলা হলো! আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই সুরে গাই, একই সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠি। আমি সবসময়ই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গণের খোঁজ রাখি। এ নিয়ে আমার আগ্রহটা কম নয়। এসময়ে বাংলাদেশের অর্ণব আর বাপ্পা মজুমদারের কাজ ভালো লাগে। এছাড়া ব্যান্ডের গান অনেক শোনা হয়।

দুই বাংলার সংগীত নিয়ে ভাবনা
বাংলা গানের বিপুল ভান্ডার অপরূপ বৈচিত্র্যে ভরা। কালে কালে দুই বাংলায় এতো বিচিত্র সুর ও বাণীর চিত্রকল্প রচিত হয়েছে যা বিস্ময়কর। এ রকম প্রসঙ্গ টেনেই মধু মুখার্জী বলেন, ‘শুধু ভাবনা থাকলেই চলবে না, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। যে কারণেই হোক, দু’বাংলার সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা এক হলেও বিনিময়ের জায়গাটায় একটা শূণ্যতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে দেশ বিভাগের পর থেকে। বন্ধুত্ব ও ভাতৃত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও যোগাযোগটা বাড়লে দু’বাংলাই উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি। তার জন্য দুজনেরই সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে ঠকিয়ে কোনোদিন ভালোবাসার চুক্তি হয় না।’

বাংলাদেশের সংগীত নিয়ে আগ্রহ
মধু মুখার্জি সংগীতের যে ধারাতেই মনোনিবেশ করেছেন সেটিই হয়ে উঠেছে স্বর্ণপ্রসূ। বাংলাদেশের সংগীত নিয়েও তিনি তার স্বপ্নের কথা বললেন। বাংলাদেশ নিয়ে আমার আগ্রহটা বরাবরই ছিলো। কিছু করার সুযোগটা সেভাবে হয়ে ওঠেনি। তবে সুযোগ পেলে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার আছে। বিশেষ করে গানের অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার কাজটা আমি সহজেই করতে চাই। এছাড়া ওখানকার শিল্পী ও সংগীত পরিচালকদের সাথে আমাদের সংগীত ভাবনার বিনিময় করার একটা সুপ্ত বাসনা আমার আছে। যা আমি বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে করতে চাই। হয়তো খুব শিগগির সেটা হবে।

প্রাপ্তি ও অপূর্ণতা
মধু মুখার্জি সমুদ্রের মত সুরের বিশালতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন ছাত্র জীবনেই। তখনই সিদ্ধান্ত নেন পেশাদার সংগীতকার হবার। এ জীবনে অনেক বড় বড় শিল্পীদের সাথে কাজ করে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করেছেন তিলে তিলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘৮০ সালে বোম্বের হিন্দি ছবি ‘কাহেকাশান’-এ আমি সংগীত পরিচালনা করি। সে ছবিতে গান গাওয়ার সুবাদে প্রথম আশা ভোঁসলের সাথে আমার দেখা এবং কথা হয়। গজল শিল্পী ভূপিন্দর সিং আশা জি’র বাসায় নিয়ে যান। সে  সময় আশা জি তার জন্য কিছু গজল তৈরি করতে বলেছিলেন আমাকে। পরে আশা ভোঁসলের ইচ্ছায় নজরুল সংগীতের একটি অ্যালবামের সংগীতায়োজন করি। যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো ওই সময়। তারও আগে বাংলার খ্যাতনামা সংগীতকার সলিল চৌধুরীর সহকারী হিসাবে কাজ করেছি দীর্ঘদিন।’

কলেজ জীবনের শুরুতেই মধু মুখার্জি কাজ করেন আনন্দ শংকরের অর্কেষ্ট্রা গ্রুপে প্রায় ৩ বছর। তিনি বলেন, ‘সেই গ্রুপে সব গুরুরা কাজ করতেন। ফলে সে অভিজ্ঞতাও আমাকে একটু একটু করে পূর্ণতা দিতে সাহায্য করেছে। শ্রেষ্ঠদের সাথে কাজ করলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কী, তা বোঝা যায়। এরকম পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সাথে কাজ করতে গিয়েও কাজের পরিধি বেড়েছে।’ নিজের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মধু মুখার্জি আরো বলেন, ‘কোন কাজ আজো ঠিকভাবে করা হয়নি। লতা জি ও কিশোর কুমারের সাথে কাজ করতে পারিনি। এ আমার বড় অপূর্ণতা ও অতৃপ্তি!’

Modhu

নচিকেতা ও হঠাৎ বৃষ্টি
অপ্রচলতি সুরের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ এক সংগীতের ভাষা নির্মাণে নীরিক্ষাধর্মী সংগীতও সৃষ্টি করেছেন মধু মুখার্জি। সুরের সাত রঙে ইচ্ছামত ছবি এঁকেছেন। দিন দিনে তিনি ঘূর্ণিবায়ুর মত ঊর্ধ্বপানে তেজস্বী হয়ে ওঠেন। পশ্চিমবঙ্গের অডিও অ্যালবাম বিক্রির সমস্ত রেকর্ড ভেঙে নচিকেতাকে শ্রোতাদের মাঝে উপহার দেন মধু মুখার্জি। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই ৮৬ সালের পরের কোন এক সময় নচিকেতাকে পাই। এমন গুণী মানুষ আমি কমই দেখেছি। তার কথা-সুর ও গায়কীর ভিন্নতা আমাকে মোহিত করেছে। প্রথম যেদিন ও আমাকে গান শুনিয়েছিলো, সেদিনই বুঝেছি এ গান ‘অন্য গান’। সমসাময়িক সময়ের সংকট ও বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এ ভাবনা থেকেই তার প্রথম অ্যালবামের কাজ করি এবং সুপার ডুপার হিট হয় সেটি। এরপরে পরপর ৮টা অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা আমিই করি। সর্বশেষ গত বছর নচিকেতার রবীন্দ্র সংগীতের অ্যালবাম ‘দৃষ্টিকোণ’র কাজটিও আমি করেছি। তবে নচিকেতার সাথে বাসু চ্যাটার্জির পরিচালনায় দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র কাজটি ছিলো মধু মুখার্জির কাজের বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘ওই ছবির গানগুলোতে একাধিক ঘরানার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কাজ করতে হয়েছিলো। অনেক নীরিক্ষাধর্মী কাজ ছিলো সেটি।’

নতুনদের নিয়ে কাজ ও পরামর্শ
বাংলাদেশের নতুন শিল্পীদের নিয়ে আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই চারমাস ব্যাপি একটি মিউজিকের কোর্স পরিচালনা করার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের একটি আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা হয়ে গেছে। প্রশিক্ষণে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীত, যন্ত্র সংগীত পরিচালনা, কন্ঠ সংগীত ও সংগীত সৃষ্টির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। যা থেকে নবীন শিল্পীরা কিছু জানতে ও শিখতে পারবে বলে জানালেন মধু। তিনি নতুনদের শিকড়ের  মত সংগীতকে আকড়ে ধরে চর্চা চালিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘নিজেকেই নিজের পথটা খুঁজে নিতে হবে। সংগীতে শর্ট-কাট বলে কোন কথা নেই। শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা নিয়ে চর্চা চালিয়ে গেলেই উপকৃত হওয়া যাবে।’

এলএ/পিআর