ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

মাসুদ পথিকের মায়ায় হলে ফেরা এবং পেছনের গল্প

বিনোদন ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪০ পিএম, ০৭ জানুয়ারি ২০২০

অতীততো জীবনেরই অংশ! পেছনটা বেশি দূরের নয়। দু’ বছর আগের কথা। মধ্যমনি বন্ধু কবি শুক্লা পঞ্চমী। প্রাণচঞ্চল মেয়েটি যেমন কথায় আন্তরিক তেমনি সারল্য অভিব্যক্তি ওর! ভাবেন সবার কথা। কাউকে সহযোগিতা করা যেন ওর মজ্জাগত জীবনের প্রকৃতি!

২০১৮ সালের হেমন্তের দুপুর। শুক্লার ফোন!
- মাসুদ পথিক নামে আমার লেখক বন্ধু ছবি নির্মাণে হাত দিয়েছে। চলচ্চিত্র তৈরিতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন! পথিকের নগদ অর্থের পথে কাঁটা বিঁধেছে। কাজ আটকে আছে! এ মুহূর্তে ওর ২ লাখ টাকা প্রয়োজন। দাও না ধার হিসেবে বন্ধু! কথা দিচ্ছি তোমার টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো।
সে মুহূর্তে আমার হাত খালি! দেশের শর্ট ফিল্ম নির্মাতা এনায়েত করিম বাবুলের (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) চাক্কি চলচ্চিত্র তৈরিতে অর্থ সহায়তা দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু মাসুদ পথিকের জন্য শুক্লার অনুরোধ রক্ষা করতে পারিনি!

নাছোড়বান্ধা শুক্লা! ক’দিন পর আবারও ওর অনুরোধ! সহযোগিতার জন্য এবার ওর ভিন্ন আবদার! ব্যাংক বীমা নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছো! ঋণ নিয়ে কারবার দেশের ব্যাংকগুলোর। একটি ব্যাংক লোন এনে দিতে পারো না? কী অইলা? ঋণের ব্যবস্থা করে মাসুদকে সহযোগিতার হাত বাড়াও দোস্ত! আমার বিশ্বাস ও ভালো ছবি বানাবে।

এই অনুরোধও রক্ষা করতে আমি সেদিন ছিলাম অপারগ! সেদিন থেকেই আমি মাসুদ পথিককে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছি!

একটু আধটু কবিতা লিখি! সমকালীন কবিদের কবিতাও পড়ি। ততদিনে শুক্লা নেট কবি থেকে অব্যাহতি নিয়ে ফেলেছে! কবি হিসেবে শিক্ষিকা ও শিল্পী শুক্লা রায় পরিণত, কবি শুক্লা পঞ্চমী হিসেবে। ভালো কবি রূপে চারদিকে ওর জয় জয়কার!

অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় একদিন বিকেলে শুক্লা বললো, ‘সমসাময়িককালের কবিদের মধ্যে মাসুদ পথিক, আদিত্য নজরুল, ওবায়েদ আকাশ এদের কবিতা পড়ো। গভীরে যায় এরা। এদের মননশীল কবিতার পাঠক আমিও।’

দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্য সাময়িকীতে কবিতায়ও চোখ রাখি প্রতি শুক্রবারে আমি। শুক্লার মতো ওদের কবিতার প্রেমে পড়ে যাই আমিও। এখনও সে ভালোলাগা ও ভালোবাসা অন্তরে প্রবাহমান। তারপর ফেসবুকে আমার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনের আহবান। আমায় গ্রহণ করেছেন সাদরে তারা। ধন্য হলাম আমি। কাছে টেনে নেন মায়া মমতায় এই সৃজনশীল ব্যক্তিরা।

টুকটাক আলাপ হয় তথ্য প্রযুক্তির গোপন ট্যানেলে। দেখা হয় কবিতা গল্পের আড্ডায় প্রকাশ্যেও।
ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে সকালে শুক্লার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ। ‘‘মায়া’ ছবিটা নাকি বেশ ভালো বানাইছে পথিক। চলো দোস্ত মাসুদ পথিকের চলচ্চিত্রটি বলাকা হলে গিয়ে দেখবো। আমি, বৌদি (সবিতা দত্ত শর্মা), তুমি ও তোমার পরিবার।’’

তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে গাড়ি করে নির্ধারিত সময় দুপুর পৌনে দু’টায় নিউ মার্কেট আঙ্গিনার বলাকা চত্বরে উপস্থিত হলাম। দু'টার শো হলো না। শুক্লা ও বৌদির আসতে পথে বিলম্ব হলো। শুক্লাকে ওর বৌদি ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন এই নাও টিকিট কাটো। ৩টা টিকিট কাটলো বন্ধু ৪৫০টাকায়। সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও রোববার পত্রিকায় চিত্র সাংবাদিকতার বদৌলতে ক্যাসেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান, নাটক এবং চিত্র সমালোচনা করেছি টানা ৫ বছর।

হলে গিয়ে ছবি দেখি না প্রায় দুই যুগ সময়। শুক্লার নিমন্ত্রণে রাজি হয়ে গেলাম আমাদের বন্ধু কবি মাসুদ পথিকের নির্মাণ বড় পর্দায় দেখবো বলে।

বীরাঙ্গনাদের সন্তানরা কেমন আছে বাংলাদেশে? একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীরা গ্রাম্য সমাজে এখনও তৎপর। স্বাধীন বাংলাদেশের সংসার জীবনে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন অনেকের মধ্যে এরা মিশে আছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আমাদের সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও বীরঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা কাজে কলকাতা থেকে এসেছেন শিক্ষিতা তরুণী মানবী বোস। যার মাটির শিকড় ছিলো এই বাংলাদেশে।

একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সহযোগিতায় গবেষণার জন্য বীরাঙ্গনাবেষ্টিত গ্রামীণ জনপদে মানবীকে গাইড হিসেবে নিয়ে যায় তরুণ রায়হান। রায়হানের গ্রামের বাড়িও সে জনপদে। মানবীকে নিয়ে রায়হান উঠে স্বাধীনতা বিরোধী চেয়ারম্যান পিতার বাড়িতে। রায়হানের সঙ্গে পিতার মতবিরোধ একাত্তরে তার নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে। গবেষণা কার্যক্রম করতে গিয়ে স্বাধীনতা সপক্ষের সমর্থনকারী আদর্শবান রায়হানের সঙ্গে মানবীর দ্বন্দ্ব হয়। মানবীকে শুরুতেই সব কিছু খুলে বলে সে। এক সময় তারা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে যৈবতী মায়াবানু বীরাঙ্গনার আসিয়ার (নার্গিস) কন্যা। চরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে ১০/১২ বছরের ছেলে মজিদ ও মেয়েকে নিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা মায়ার বসবাস। একাত্তরে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে নির্মমভাবে নির্যাতিতা বৃদ্ধা মায়ের কাছে থাকে সে। তার মৃত চাচাতো বোনের ছেলে চাষা জব্বর। একই পরিবারে থাকে। কথা অসংলগ্ন তার। জাগতিক সংসারের সত্যগুলো সে আপন মনে ও চাক্ষুসে বলে ফেলে।

গ্রামবাসী কারো কারো পাকিস্তানি জারজ সন্তানের অপবাদে জীবনের স্বাভাবিক গতিময়তা হারিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু জব্বর ক্ষেতের চাষকর্মে ভালো। যুবতী মায়ার মতো তারও জৈবিক তাড়না আছে। প্রচলিত বিবাহের সমাজপ্রথাকে ডিঙ্গিয়ে দেহানন্দের মোহনায় তারা মিলিত হয়। কামনার জোয়ারে ফসল রোপিত হয় মায়াবানুর জঠরে। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী গ্রাম্য সমাজপতিদের মুখোমুখি হতে হয় চরমভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত পরিবারের মায়াকেও।

গ্রাম সরকার মাতাব্বরদের শালিসে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মায়া। চেয়ারম্যানের অন্যায়, অমানবিক ও পৈশাচিক কৃতকর্মের প্রকাশ্য উন্মোচনের পর মেম্বারের হামলায় ভূলুন্ঠিত মায়ার গর্ভপাত। প্রতিশোধের আগুনে জব্বর উন্মাদ হয়ে কৃষিকাজে ব্যবহৃত ধারালো দা দিয়ে পাকিস্তানি এ দোসরদের নির্মূল করে। এমন গল্পেই সমাপ্তি ঘটে ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ছবির।

এ চলচ্চিত্রে ডিটেইলসের কাজ আছে বেশ। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে অধিকাংশ বহিরাঙ্গনে ছবির চিত্রায়ন। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার নেই বলেই চলে। ছায়াছবির আলো ও দৃশ্যসজ্জা দেখতে গিয়ে ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃনাল সেনের প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

তবে আবহ সংগীত মন কাড়েনি। গানের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ছিলো না বলেই মনে হলো। দেশীয় ছবিতে নতুন দিক হিসেবে কবিতার সংশ্লিষ্টতা আলাদা মাত্রা দিয়েছে। মায়া চলচ্চিত্রে অভিনয় শিল্পী হিসেবে পেশাদারদের তুলনায় দেশের কবিরা ভালোই করছেন। কবি কামাল চৌধুরীর যুদ্ধশিশু কবিতা যেমন এসেছে, তেমনি তিনি স্বাভাবিক অভিনয়ও যুক্ত ছিলেন।

মাদ্রাসার হুজুর চরিত্রে ছড়াকার আসলাম সানীর অভিনয় সত্যি মনে রাখার মতো। ছোট একটি চরিত্র অথচ নৈপুণ্য প্রদর্শনে উজ্জ্বল। মেম্বারের ছোট একটি চরিত্রের অভিনয়ে কবি শাহাদত হোসেন নিপুর পারফরমেন্স অনবদ্য। গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে কবি রহিমা আখতার কল্পনা লোকজ গান চোখে পড়েছে।

কবি ও নির্মাতা মাসুদ পথিক চাষার পুত ভালো হুঁকো টানতে পারেন ফসলের মাঠের অভিনয়ে তা বুঝা গেলো।

নতুন হিসেবে রায়হান চরিত্রে দেবাশীষ কায়সার সাবলীল। জড়তা নেই তার অভিনয়ে। জব্বর প্রাণ রায়ের অভিনয় প্রাণ ছুঁয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে জ্যোতিকা জ্যোতি স্বতঃস্ফূর্ত। মানবী চরিত্রে মুমতাজ সরকারকে দর্শক মনে রাখবে।

কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার মধ্যবর্তী এলাকা এ ছবির পটভূমি। কিন্তু ছবিতে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষাটা কোন অঞ্চলের তা অস্পষ্ট। গ্রামে মানবীকে সেলফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু চেয়ারম্যানের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও উন্নয়ন দেখা গেলো না। এখানে কি শুধু পোশাকের উন্নয়ন? অথচ ছবির চরিত্রগুলোর ব্যবহৃত পোশাক উন্নত ও নতুন।

মানুষ তো প্রতিদিনই নতুন পোশাক পরে না। সেটা শহর কিংবা গাঁয়ের মানুষ যাই হোক না কেন। কস্টিউম ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি চোখে পড়েছে। তারপরও বলবো সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ছবির নির্মাতা হিসেবে কবি মাসুদ পথিক সত্য উন্মোচনে নির্ভীক ছিলেন। এমন সাহস যেন বজায় থাকে আমৃত্যু। সত্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের ইতিহাসভিত্তিক সত্য ঘটনার চিত্র নির্মাণে মাসুদ পথিককে বারবার দেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক : প্রণব মজুমদার
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]

এলএ/পিআর

আরও পড়ুন