এত নায়িকা রেখেও কেন বাড়ছে ভারতীয় নায়িকা আমদানি?
কলকাতার তারকারা এপার বাংলার সিনেমায় কাজ করেছেন সেটা বেশ পুরনো কথা। প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা, শতাব্দী রায়সহ অনেকেই এদেশের সিনেমায় কাজ করেছেন। ঢাকার অনেক তারকা কলকাতায় গিয়ে কাজ করেছেন। দুই দেশের নির্মাতারাও আসতেন ও যেতেন। সেটা ছিল দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরির একটি সুন্দর প্রচেষ্টা।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকট হয়েছে ভারতীয় সিনেমার একতরফা প্রভাব। সাফটা সুবিধার নাম করে আনা হচ্ছে যেমন ভারতীয় সিনেমা তেমনি ভারতীয় নায়ক-নায়িকা আমদানিরও হিড়িক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদেশের সিনেমায় ভারতের সিনেমার প্রভাব আছে গল্প চুরি করায়ও। ফ্রেম টু ফ্রেম দৃশ্য নকল করে এ দেশে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে চলছে পরিচালক-তারকাদের গলাবাজিও।
তবে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে ভারতীয় নায়িকা আমদানির দৌড়ঝাঁপ। সাংবাদিক থেকে শুরু করে কলকাতার মিডিয়ায় যোগাযোগ হয় এমন লোকদের কাছে সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকরা নিত্যই কলকাতার নায়িকাদের খোঁজ করেন।
জানতে চান অমুক নায়িকার পারিশ্রমিক কতো? অমুক নায়িকা সিনেমার প্রতি কতোটা আন্তরিক? অমুক নায়িকা বাংলাদেশি সিনেমা করতে আগ্রহী কী না?
আগ্রহের এই তালিকায় এগিয়ে কলকাতার শ্রাবন্তী ও শুভশ্রী। বেশ কয়টি ছবি তারা করেছেন বাংলাদেশে। সেগুলো আলোচনায় এসেছে। তাই প্রযোজকরা প্রথমেই টার্গেট করেন এই অভিনেত্রীদের।
তালিকায় তারপর আছেন কোয়েল মল্লিক। অনেকেই অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছেন এই নায়িকাকে ঢাকায় এনে সিনেমা করানোর। কিছু নাম ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে নিয়ে কোনো শুটিং শুরু করেননি বাংলাদেশের কোনো নির্মাতা।
এরপর নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তী, পাওলি দাম, প্রিয়াঙ্কা সরকারদের প্রতি আগ্রহ রয়েছে ঢাকাই সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকদের। কিছু বিশেষ চরিত্রের জন্য অনেকেই স্বস্তিকা মুখার্জি, শ্রীলেখা মিত্রকে চান। এরই মধ্যে পারভেজ আমিন নামে এক পরিচালক ঘোষণা দিয়েছেন স্বস্তিকাকে নিয়ে একটি সিনেমার।
অনেকে আবার টার্গেট করেন কলকাতার বাংলা সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্রে খুব সহজেই বাড়ছে এসব অভিনেত্রীদের সাথে ঢাকার চলচ্চিত্রের মানুষদের যোগাযোগ। অনেকের মধ্যে বন্ধুত্বও গড়ে উঠছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
কলকাতার বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হওয়া নাটক দেখে কোনো অভিনেত্রীকে পছন্দ হলে তাকে টার্গেট করেন প্রযোজক-পরিচালকরা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে সিনেমায় কাজের প্রস্তাব দিচ্ছেন। দুঃখের ব্যাপার হলো এক্ষেত্রে কলকাতার বেশিরভাগ টিভি অভিনেত্রীই ভালো মন্দ যাছাই না করে সম্পর্ক বা কাজের চুক্তিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন।
তবে কপালে ভাঁজ পড়ার মতো ব্যাপার হলো, হঠাৎ করে কেন এভাবে ভারতীয় নায়িকাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি? আজকাল দশটা সিনেমার নাম ঘোষণা হলে সেখানে সাতটি ছবির নায়িকা হিসেবে কলকাতার নায়িকাদের নাম শোনা যায়। প্রথম নায়িকা হিসেবে না হলেও কোনো না কোনোভাবে কলকাতার নায়িকাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
যদিও শেষ পর্যন্ত সেই সব ছবির বেশিরভাগই শুটিং শুরু করতে পারে না। যেগুলোও বা করে তার অধিকাংশই শুরু হয় দেশের নতুন কোনো মুখ নিয়ে। অথবা ছোট পর্দা থেকে তুলে আনা হচ্ছে বড় পর্দায়। ঘোষিত কলকাতার নায়িকাটিকে আর দেখা যায় না। আবার দেশের জনপ্রিয় নায়িকাদেরও নেয়া হয় না ছবিগুলোতে। যেখানে বিভিন্ন প্রজন্মের পপি, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, মাহি, মিম, পরীমনি, নুসরাত ফারিয়া, আঁচল, তমা মির্জা, আইরিন, ববি, পূজার মতো নায়িকারা রয়েছেন।
কিন্তু কেন? কলকাতা বা ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের চেয়ে গুণেমানে ভালো অভিনেত্রী তো দেশেই রয়েছে। বিভিন্ন প্রজন্মের নায়িকারা এখানে প্রায় সিনেমাহীন দিনযাপন করছেন। তাহলে দেশে এত নায়িকা রেখে তাহলে কেন বিদেশি নায়িকা আমদানি হচ্ছে?
সেই প্রশ্নের উত্তর যে জবাব আসে তাতে দেশের নায়িকাদের ওপরই দায় বর্তায়। তাদের ব্যর্থতাই বিদেশি নায়িকাদের ভিড় বাড়াচ্ছে।
বেশকিছু কারণে দেশের নায়িকাদের এড়িয়ে চলেন প্রযোজক ও পরিচালকরা। তার অন্যতম কারণ সিনেমার প্রতি দেশি নায়িকাদের আন্তরিকতার অভাব। সেই সঙ্গে দেশের নায়িকাদের নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। তার চেয়ে বিদেশি নায়িকাদের নাগাল পাওয়া খুব সহজ বলেও মন্তব্য করেন অনেক নির্মাতা।
প্রযোজক ও পরিচালকরা বলেন, ‘এখানকার নায়িকারা বেকার বসে থাকবেন কিন্তু কোনো কম্প্রোমাইজ করে কাজ করবেন না। সেটা যতোই ভালো চরিত্র হোক। ভালো গল্প ও চরিত্রের জন্য এক পয়সা স্যাক্রিফাইস করতে রাজি হন না কেউ।’
একদিকে আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক চান। যদিওবা চুক্তি হয় তারপর দেখা দেয় তাদের চাহিদার বিড়ম্বনা। সেটা যেমন খাবারের তেমনি যাতায়াতেরও। এছাড়া নায়িকা হিসেবে বাড়তি সুযোগ নেয়ার চেষ্টাও করেন শুটিং স্পটে।
অনেকে চুক্তি করে অগ্রিম টাকা নিয়েও শিডিউল ফাঁসান। কিছু বলা যায় না। অনেক নায়িকা আছেন যারা শুটিংয়ে ঠিক টাইমে সেটে আসেন না। অনেকে শুটিংয়ে বসে মোবাইল নিয়ে বা আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন। কাজের প্রতি মনোযোগী হন না। এভাবে কাজ করাটা অনেক কঠিন।
কিন্তু কলকাতার নায়িকারা বেশ সিরিয়াস কাজের প্রতি। যারা সাধারণত বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী তাদের খুব সহজেই পাওয়া যায়। পারিশ্রমিকটাও কম লাগে। দেশের জনপ্রিয় নায়িকারা যে পারিশ্রমিক পান সে টাকার প্রায় ২০-৩০ ভাগ কম দিয়ে কলকাতার শ্রাবন্তীকে পাওয়া যায়। কেন তাহলে লোকে বিকল্প পথ ব্যবহার করবে না!
এছাড়া কলকাতার নায়িকারা যতদিন শিডিউল দেন মন দিয়ে নিজের কাজটুকু শেষ করে যান। একটি সিনেমায় যুক্ত হওেয়ার পর থেকে সেটিকে নিজের বলে মনে করেন। ছবি মুক্তির পরও তারা সেই সিনেমা নিয়ে কথা বলেন, কাজ করেন। এজন্যই তাদের প্রতি আগ্রহ সবার।’
শোনা যায়, প্রযোজকদের চেয়ে পরিচালকরাই দেশি নায়িকাদের এড়িয়ে চলেন বেশি। কারণ মাঠে নেমে হাতে-কলমে তাদেরই ‘নায়িকা’ মোকাবিলা করতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তরুণ এক নির্মাতা বলেন, ‘দেশের জনপ্রিয় নায়িকাদের আন্তরিকতা খুবই কম। তাদের পেশাদারিত্ব বলতে কেবল পারিশ্রমিকের বেলায়। আমরা অনেক নামকরা অভিনেত্রীদের অনেক চমৎকার গল্প শুনি। কিন্তু আফসোস, এই মুহূর্তে তেমন নায়িকা আমাদের নেই।’
এখনকার নায়িকারা তো সিনেমার প্রচারে আসতেই চান না। তারা মনে করেন তাদের মুখের কথার অনেক দাম। সেজন্য কোথাও সাক্ষাৎকার দিলে টাকা চান। তারা বলিউডের উদাহরণ দেয় যে প্রচারণার জন্য বাজেট দরকার। টাকার বেলায় তারা বলিউডকে দেখেন। কিন্তু তারা এটা দেখেন না বলিউডের নায়িকারা একটা ভালো কাজের জন্য কত স্যাক্রিফাইস করেন। অনেকে পারিশ্রমিক পর্যন্ত নেন না যেখানে প্রয়োজন পড়ে। পথে হেঁটে হেঁটে সিনেমার প্রচারণার করেন। কিন্তু আমাদের নায়িকাদের এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।
এই দেশে শাবানা-ববিতারাও অনেক স্যাক্রিফাইসের নজির রেখে গেছেন। তারা এমনি এমনি সবার মধ্যমণি হয়ে ওঠেনি। এখন নায়িকাদের মূল টার্গেট অর্থবিত্ত। শিল্পচর্চা করে শিল্পী হিসেবে কবরী-শবনমদের মতো অমর হওয়ার ইচ্ছা তাদের মধ্যে দেখা যায় না।
একটা নতুন মেয়ে এসে একটু নাম করলেই সে টাকার মেশিন হয়ে উঠছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির জন্য, নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভালো কিছু করাটা রপ্ত করতে পারে না। কে চায় এত ঝক্কিঝামেলা করে সিনেমা করতে! কম ঝামেলার বলেই কলকাতার নায়িকাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ইন্ডাস্ট্রির।’
অনেকে টেনে আনলেন আরও একটি সংকটের কথা। তাদের দাবি, কিছু নায়িকা রয়েছেন যারা সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে চলেন। ওই নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে তারা কাজ করেন না। সিনেমার যে চরিত্রটি সেটি হয়তো ওই নায়িকাকেই মানাতো। কিন্তু তাকে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বিদেশি নায়িকা আনতে হয়। অথবা দেশি নতুন কাউকে নিয়ে সিনেমা করতে হয়। তবে এটা খুব ঝুঁকির। তাই বিদেশেই নজর সবার।
এলএ/জেআইএম