মা আছে কিন্তু গুরুত্ব নেই
মা আগলে রাখেন সংসার। নীরবে শত ত্যাগ করে তিনি মমতার বীজ বুনে চলেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের জন্য। আর সন্তানদের জন্য তো তার ভূমিকা কোনো কলমের কালিতেই লিখে শেষ করা যাবে না। মরতে মরতেও মায়ের মুখে থাকে সন্তানের জন্য ভালোবাসা।
মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই মা গুরুত্ব হারিয়েছে ঢাকাই সিনেমাতে। একটা সময় এদেশের চলচ্চিত্রে মায়ের চরিত্রে দেখা মিলতো জাঁদরেল অভিনেত্রীদের। যাদের অভিনয় হাসাতো দর্শককে, কাঁন্নায় ভাসাতো আবেগে। অনেক সিনেমার অনেক দৃশ্যই কালজয়ী হয়ে আছে মায়ের চরিত্রে।
ঢাকাই সিনেমায় মায়ের চরিত্র বলতেই চোখে ভেসে উঠে দুটি ট্রেন্ড। একটি হলো দরিদ্র মা। যিনি আজীবন ত্যাগ আর অভাবের সাথে পাঞ্জা লড়ে যান নিজের সন্তান ও পরিবারকে ভালো রাখতে। এখানে মা নানা রকম অত্যাচারের শিকার, প্রতারণায় আক্রান্ত, মমতাময়ী, সংযমী, প্রতিবাদী, আদর্শ একজন মানুষ। সেইসব মায়ের চরিত্রে বহুবার পর্দা কাঁপাতে দেখা গেছে আনোয়ারা, শাবানা, ববিতা, ডলি জহুর, খালেদা আক্তার কল্পনাকে।
আরেকটি ট্রেন্ড রয়েছে বিত্তবান মায়ের। যেখানে দেখা যায় শিক্ষা আর অর্থের দম্ভে সংসারের প্রতি উদাসীন মা। তিনি ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানরা বখে যায়। তিনি দজ্জাল হয়ে উঠেন সন্তানের প্রেমে বাঁধা দিতে। কখনো কখনো তিনি হয়ে উঠেন দজ্জাল শাশুরিও। রিনা খান, নাসিমা খান, নূতন এইসব চরিত্রে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
ভালো কিংবা মন্দে যেমন চরিত্রেই হোক একটা সময় পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় মায়ের চরিত্রের গুরুত্ব ছিলো। সেই চরিত্রটি পুরো সিনেমার বিরাট একটি অংশ জুড়ে থাকতো। তারা ছবিতে আবেগ দিতেন, ক্লাইমেক্স দিতেন, বিনোদন দিতেন, আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতেন।
কেবলমাত্র মাকে কেন্দ্র করেও সিনেমা তৈরি হয়েছে ঢাকাই সিনেমাতে। যার মধ্যে উল্লেখ করা যায়- মায়ের দোয়া, দমকা, মায়ের অধিকার, সুন্দরী বধু, বুকের ভেতর আগুন, বাংলার মা, বর্তমান, কষ্ট, মায়ের সম্মান, আম্মাজান, আমার ঘর আমার বেহেশত, খোদার পরে মা, মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবিসহ বেশ কিছু ছবির নাম। এসব ছবিতে মায়ের উপর আবর্তিত হয়েছে গল্প।
বিভিন্ন সময় এই দেশের চলচ্চিত্রে ফেরদৌসী মজুমদার, আনোয়ারা, শাবানা, ববিতা, শবনম, ফাল্গুনী হামিদ, ডলি জহুর, নাসিমা খান, রেহানা জলি, খালেদা আক্তার কল্পনা, নূতন, সুচরিতা, সুচন্দা, কবরী অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে। প্রায় সব ছবিতেই মায়ের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতো গল্পের প্রয়োজন ও নির্মাতাদের মুন্সিয়ানায়।
কিন্তু সেই সময় আর নেই। গেল প্রায় ৭-৮ বছর ধরে সিনেমাতে ‘মা’ গুরুত্বহীন একটি শব্দ হয়ে পড়েছে। এ দেশের দর্শক হয়তো ক্যালকুলেটর নিয়ে বসেও হিসেব করে বের করতে পারবে না সর্বশেষ কোন ছবিতে মায়ের চরিত্রে তারা মুগ্ধ হয়েছেন, মায়ের আবেগ ছুঁয়ে গেছে তাদের মন।
এখন ছবিতে মা আসেন কেবলই একজন নায়ক বা নায়িকার জন্মগত বৈধতা দিতে। এর বেশি কিছু পাওয়া যায় না সেইসব চরিত্রে। না দেখা যায় প্রয়োজনীয়তা, না মেলে গভীরতা। আর একারণেই মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতেও আগের মতো আগ্রহ দেখান না নামি অভিনেত্রীরা।
বিশেষ করে আনোয়ারা, ববিতা, সুচরিতা, কবরী, শর্মিলী আহমেদ, ডলি জহুরদের দেখা মিলে না বললেই চলে। তাদের অভিযোগ যেসব চরিত্রের প্রস্তাব পান সেগুলোতে নতুনত্ব নেই, গভীরতা নেই। পাঁচটা দশটা দৃশ্য দিয়ে কেবল সিনেমার গল্প লম্বা করা হয়েছে।
কেউ কেউ অভিযোগ করেন পারিশ্রমিক নিয়েও। অভিযোগ আছে সিনেমার শুটিংয়ে সিনিয়র অভিনেত্রীদের প্রতি অবহেলা নিয়েও। শুটিং ইউনিটের সবাই নায়ক ও নায়িকা নিয়ে অকারণে ব্যস্ত থাকে। কিন্ত চলচ্চিত্রের কয়েক দশক মাতিয়ে রাখা অভিজ্ঞ ববিতা-কবরীদের প্রতি নজর থাকে না কারো। এগুলো মেধা ও গুণীর অবমূল্যায়ণ মনে করে অনেক তারকা অভিনেত্রীই এখন আর মায়ের চরিত্রে কাজ করতে চান না।
সেইসঙ্গে অভিনেত্রীদের কেউ কেউ এমন অভিযোগও করেন যে ছবির চিত্রনাট্য থেকে মায়ের চরিত্র কেটে ফেলা হয় নায়ক বা নায়িকার নির্দেশে। এডিট প্যানেলে আরেক দফায় কাটাকাটি চলে মায়ের চরিত্রে। শেষ পর্যন্ত হলে গিয়ে আর নিজের চরিত্রের কিছুই খোঁজে পাওয়া যায় না।
অভিনেত্রী সুচরিতা বলেন, ‘মা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ। যার ভেতরে পরিবারের প্রতি দায়বোধ আছে, মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে তিনি যখন পারিবারিক কোনো সিনেমা করবেন বা যে কোনো সিনেমাতেই চেষ্টা করবেন পরিবারের গল্প টেনে আনতে। মায়ের চরিত্রকে গুরুত্ব দিতে। এখন সেইসব মূল্যবোধ কমে গেছে।
সবকিছু তারকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সেজন্য দর্শকও সিনেমার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না। সে সিনেমায় গিয়ে নায়ক-নায়িকা দেখে নিজেকে খোঁজে পেলেও তার পরিবার-পরিচিতিকে পায় না। তখন সে ওই ছবিটিতে মজা পায় না।’
এলএ/পিআর