ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় যতো গান
১৯৯৭ সাল। ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া হয়নি, টেস্ট তো দূরের কথা। আইসিসি ট্রফিতেও সুবিধা করতে পারে না টাইগাররা। জিম্বাবুয়ের কাছে বরাবর হেরে যাওয়া। তখন এক অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেলো।
কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে গেলো। সারা বাংলাদেশটাই যেন বদলে গেলো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রঙ খেলা। ট্রাক ভর্তি করে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের পর নানা ক্রান্তিকাল আর দুঃশাসনের বাংলাদেশে তখন পর্যন্ত এতো আনন্দের কিছু ঘটেনি। ‘বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ’- এই এক আনন্দেই উৎসবের মহামঞ্চ হয়ে গেল ৫২ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক রকম অর্জনই বাংলাদেশিদের মহিমান্বিত করেছে, গর্বিত করেছে। তবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ক্রিকেটের ভূমিকা সবার উপরেই বলা যায়। দু মুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচা মানুষটিও স্বপ্ন দেখেন তার সন্তান একদিন বাংলাদেশের হয়ে জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলবে।
এদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এখানেই টের পাওয়া যায়। এখনো তেমন কোনো বড় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়নি বাংলার টাইগারদের, কিন্তু তারুণ্যের হুঙ্কার ছড়ানো বহু ম্যাচ দিয়ে তারা ক্রিকেট দুনিয়া কাঁপিয়েছে, জিতে নিয়েছে প্রশংসা ও সমীহ। তাই বাঙালির কাছে প্রাণের আবেগ মেশানো একটি শব্দ।
ক্রিকেট নিয়ে বড় কোনো টুর্নামেন্ট শুরু হলেই উৎসব আমেজ দেখা দেয় বাংলাদেশে। দলের সামর্থের চেয়েও বেশি থাকে প্রত্যাশা ও উৎসাহ। আর সেই আমেজের স্রোতে ক্রিকেট জায়গা করে নিয়েছে এদেশীয় শিল্প সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে।
ক্রিকেট নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য নাটক, সিনেমা ও গান। তবে ক্রিকেট নিয়ে গানের ভুবনেই মাতামাতাতিটা বেশি চোখে পড়ে। সেই প্রথম বিশ্বকাপে যাওয়া ১৯৯৯ সালের পর থেকেই প্রায় প্রতি বছরই দুই একটা গান প্রকাশ হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে। চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক সেইসব গানের মধ্যে সেরা ও জনপ্রিয় গানগুলোর উপর।
ক্রিকেটের গানে রাজপুত্র শুভ্র দেব
তখনও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ খেলেনি। ১৯৯৮ সালে আমি প্রথম ক্রিকেট নিয়ে গান করি। নাম ছিলো ‘ক্রিকেট ক্রিকেট’। এরপর ক্রিকেট নিয়ে আরও বেশকিছু গান গেয়েছি’- বলছিলেন নন্দিত গায়ক শুভ্র দেব।
তারও আগে ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপের সময় নিজের কথা ও সুরে শাকিলা জাফরের সঙ্গে গেয়েছিলেন ‘একই বিশ্ব একই খেলা’ শিরোনামের গান। তবে শুভ্র দেব ক্রিকেট বিশ্বের আলোচিত ছিলেন ওই মিনি ওয়ার্ল্ড কাপের থিম সং করে।
তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন। বাংলাদেশে এত বেশি খেলা হতো না আজকের মতো। প্রথম বাংলাদেশে মিনি বিশ্বকাপ ক্রিকেট হয় এবং তিনি থিম সং করার সুযোগ পান। এটা শুভ্র দেবের ক্যারিয়ারে সাফল্যের সোনালী পালক যোগ করে দেয়।
সেই থিম সংটি ইএসপিএন এবং স্টার স্পোর্টস প্রচার করে প্রতিটি ম্যাচেই। শুভ্র দেব বলেন, ‘মনে পড়ে ফাইনাল ম্যাচে সাউথ আফ্রিকা বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ বলটা যখন হবে তখন আমার গাওয়া থিম সং লাইভ প্রচার করা হয়েছে। ১৬৮টি দেশে এই গান দেখানো হয়। এটা আমার কাছে একটা বড় অর্জন হয়ে আছে।’
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সময় আসাদুজ্জামান নুরের লেখা ‘গুডলাক বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দেন শুভ্র দেব। তার সঙ্গে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন শাকিলা জাফর, সৈয়দ আব্দুল হাদি এবং সুবীর নন্দী। ওই একই বছর গেয়েছিলেন ‘হাউজ দ্যাট’ শিরোনামের আরেকটি গান। এরপর ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেলে লিখেন ‘চার মারো মারো রে ছক্কা মারো মারো রে’। এছাড়া ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ‘বাংলাদেশ জেগে উঠো’ শিরোনামে আরেকটি গান করেন শুভ্র দেব। এই গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
লাকী আখন্দের হঠাৎ বাংলাদেশ আজও হৃদয় দোলায়
দীর্ঘদিন গান থেকে দূরে ছিলেন। ১৯৯৯ সালে বিরতি ভেঙে ফিরে এলেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে প্রেরণা দিতে। তিনি গেয়েছিলেন ‘হঠাৎ করে বাংলাদে’ শিরোনামের গান। নিজের লেখা ও সুরে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। সেই গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো বিটিভি আর বাংলাদেশ বেতারের হাত ধরে। আজও এই গান নব্বই দশকের সোনালী প্রজন্মকে নস্টালজিক করে তুলে।
ক্রিকেটে সবচেয়ে জনপ্রিয় আসিফ আকবরের গানটি
‘বেশ বেশ বেশ/ সাবাস বাংলাদেশ’- গানটি শুনলেই ক্রিকেটপ্রেমীরা উৎসাহ-উল্লাসে ফেটে পড়েন। এই গান যেমন বিজয়ের উৎসবকে রাঙিয়ে দেয় তেমনি পরাজয়ের গ্লানি মুছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণাও দেয়। সোহেল আরমানের লেখা এবং ইবরার টিপুর সুরে এই গানটি ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। দেশের হাট-মাঠ-পথে প্রান্তরে ক্রিকেটের আমেজে সর্বত্রই বেজে উঠে এই গান।
হাবিবের কণ্ঠে চলো বাংলাদেশ
২০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে উজ্জীবিত করতে তৈরি হয় ‘চলো বাংলাদেশ চলো বিশ্ব উঠানে’ শিরোনামে একটি গান। এটি তৈরি করেন জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ।
গানটিতে হাবিবের সঙ্গে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন শুন্য ব্যান্ডের এমিল এবং নেমেসিস ব্যান্ডের জোহাদ। নতুন প্রজন্মের শ্রোতা ও ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই গান খুব জনপ্রিয়। ক্রিকেট মৌসুমে এই গানের রিংটোন শুনতে পাওয়া পথে ঘাটে-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে।
ফুয়াদের চার ছক্কা হইহই
২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ছিলো ক্রিকেটের গানের বছর। বহু গান বহু শিল্পীরা বাজারে নিয়ে আসেন এ সময়। তবে সবাইকে ছাপিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ফুয়াদ আল মোক্তাদিরের ‘চার ছক্কা হইহই’ শিরোনামে একটি গান। ফুয়াদের সংগীতায়োজনে গানটিতে কণ্ঠ দেন পান্থ কানাই, কণা, এলিটাসহ অনেকে। তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে গানটি।
মেহরীনের থিম সং
২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের থিম সং ছিলো ‘দেশজুড়ে উৎসব, মনজুড়ে রোশনাই, জোরসে বলো, কাপ কিন্তু একটাই’। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন জনপ্রিয় পপগায়িকা মেহরীন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফিসিয়াল স্পন্সর বেক্সিমকো। এই প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগেই গানটি রেকর্ডিং করা হয়েছে।
বিভিন্ন এফএম রেডিও, টিভি চ্যানেলের সৌজন্যে গানটি পৌঁছে গিয়েছিলো সারাদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষদের কাছে। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো এটি।
দূরবীন
২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য গান নিয়ে হাজির হয় দূরবীন ব্যান্ড। তাদের ‘জ্বলে উঠো বাংলাদেশ’ গানটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
আরেফিন রুমি
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় টি- টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে উৎসাহ দিতে গান তৈরি করেন আরেফিন রুমি। রবিউল ইসলাম জীবনের কথা এবং আরেফিন রুমির সংগীতায়োজনে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, আরেফিন রুমি, লিজাসহ অনেকে।
মাইলস
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে উৎসাহ দিতে ২০০০ সালে ‘বিস্ময়ের যাত্রা’ নামে মাইলস ব্যান্ড একটি গান প্রকাশ করে। সেটি বেশ আলোচিত হয় ক্রিকেট ভক্তদের কাছে। মাহমুদ খুরশিদ ও শাফিন আহমেদের কথা ও সুরে এই গানটি তাদের ‘প্রবাহ’ অ্যালবামে প্রকাশ হয়েছিলো।
এছাড়াও ক্রিকেটের গান হিসেবে জনপ্রিয় মিলন মাহমুদের গাওয়া ‘লাল সবুজের পতাকা’, হেভি মেটাল ব্যান্ড ক্রিপটিক ফেইটের ‘চলো বাংলাদেশ’ আর্টসেলের ‘গর্জে উঠুক বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।
এলএ/পিআর