নিভে গেল সব তারা, আমরা তাদের ভুলব না
এক পরিবারের তিন কিংবদন্তী। তিনজনই গানের আঙিনায় ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা। তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কালজয়ী বহু গানের নাম। কেউ সুর করেছেন, কেউ বা গেয়েছেন। তারা তিন ভাইবোন; আনোয়ার পারভেজ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও জাফর ইকবাল।
তবে গানের মানুষ হিসেবে স্বপ্নযাত্রা শুরু করলেও শাহনাজ রহমতুল্লাহর ছোট ভাই জাফর ইকবাল বাংলাদেশি সিনেমার নায়ক হিসেবেই বেশি জনপ্রিয় ও স্মরণীয়। তাকে চিরসবুজ নায়কের মর্যাদা দিয়েছে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি।
এম ফজলুল হক ও আসিয়া হক ছিলেন সুখী দম্পতি। তাদের পারিবারিক বলয় ছিলো সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। সেই দাম্পত্যের বড় তারাটির নাম আনোয়ার পারভেজ। বাংলাদেশের সংগীতে এক কলজয়ী সুরস্রষ্টার নাম। যার হাত ধরে এসেছে দেশের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। বন্ধু গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে দিয়ে গানটি লিখিয়েছিলেন তিনি। আর কণ্ঠ দেয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন নিজেরই ছোট বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহকে।
বাকিটুকু ইতিহাস। এই গান বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গানের তালিকায় ৯ নম্বরে অবস্থান করছে। এই ত্রয়ীর আরও কিছু গান রয়েছে যা শ্রোতাপ্রিয় এবং কালকে জয় করে টিকে আছে মানুষের মুখে। জায়গা পেয়েছে বিবিসির জরিপের সেরা বিশের তালিকাতেও। সেগুলো হলো ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’।
আনোয়ার পারভেজের সঙ্গীত জীবন শুরু হয় ষাটের দশকে। চট্টগ্রাম বেতারে সুরকার পদে যোগদানের মাধ্যমে তার পথচলার শুরু। পরে ঢাকায় এসে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগীত পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের সুর করেন।
স্বাধীনতার পরই বাংলাদেশের একটি অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি ‘রংবাজ’-এর সুরকারও ছিলেন তিনি। সে সময় ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না’, ‘এই পথে পথে’, ‘আমি একা চলি’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি দুই হাজারেরও বেশি গানে সুর দিয়েছেন। ২০০৬ সালে ১৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি মরনোত্তর একুশে পদক পান।
এই পরিবারের মেজ সন্তান জাফর ইকবাল। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫১ সালের ১৯ এপ্রিল। গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। ছোটবেলাতেই তালিম নিয়েছেন সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের উপর। অন্য দুই ভাইবোন যখন গান করতেন ছোট্ট জাফর ইকবাল তখন তবলা হাতে বসে যেতেন তাদের সঙ্গী হয়ে।
১৯৬৬ সালে প্রথম একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন তিনি। সিনেমায় তার প্রথম প্লে-ব্যাক করা গান ছিল ‘পিচ ঢালা পথ’। তার কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
তবে মুক্তিযুদ্ধের আগ মুহূর্তে তিনি চলচ্চিত্রে নাম লেখান এবং রাজ্জাক-ফারুক-আলমগীরদের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আশির দশকের সেরা নায়ক হিসেবে।
১৯৭৫ সালে ‘মাস্তান’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জাফর ইকবাল ১৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’ ইত্যাদি।
১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জাফর ইকবাল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি সম্মানিত দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে।
দুই ভাইয়ের আদরের বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এই শিল্পী অল্প বয়সেই গায়িকা হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করেন পাকিস্তান রেডিও ও টিভিতে। তখন তিনি শাহনাজ বেগম নামে পরিচিতি পান। দেশাত্মবোধক গানের জন্য তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ; দুই দেশেই সমাদৃত।
১৯৬৩ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। সেই চলচ্চিত্রের নাম ছিলো ‘নতুন সুর’। এরপরের বছর ১৯৬৪ সালে প্রথম টেলিভিশনে গান করেন শাহনাজ। এরপর ধীরে ধীরে তিনি শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি বাড়তে থাকে তার।
শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায়’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি’, ‘আরও কিছু দাও না’, ‘এই জীবনের মঞ্চে মোরা কেউবা কাঁদি কেউবা হাসি’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।
তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক পান শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
দুই ভাইয়ের পথ ধরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন বোন শাহনাজও। এই পরিবারের সর্বশেষ কিংবদন্তী হিসেবে বেঁচে ছিলেন সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তিনিও রোববার (২৪ মার্চ) রাত ১টায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই পরিবারের তো বটেই, বাংলাদেশের গানেরও বিরাট অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
একে একে চলে গেলেন তিন ভাইবোন। রয়ে গেছে তাদের অনন্য সৃষ্টিশীলতা। সেই সৃষ্টি বুকে নিয়ে চিরকাল গর্বিত হবে বাংলাদেশ।
এলএ/পিআর