ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

আমি নারী দিবস বিশ্বাস করি না : শিমুল ইউসুফ

মাসুম আওয়াল | প্রকাশিত: ০৮:৩৫ পিএম, ০৭ মার্চ ২০১৯

শিমুল ইউসুফ শিল্প সাংস্কৃতিক ভুবনের এক উজ্জ্বল নাম। বাংলা অভিনয়রীতি বিকাশে এবং শুদ্ধ সঙ্গীতচর্চায় অবদানের জন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকর্তৃক তাকে ‘মঞ্চকুসুম’ উপাধি দিয়েছিলেন। এখনও সংগীত ও মঞ্চকে ঘিরেই চলে তার প্রতিটি নিঃশ্বাস। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেকে জড়িয়েছিলেন সেই ছোটবেলায়। অভিনয়, নাট্যনির্দেশনা, সঙ্গীতসহ শিল্পাঙ্গনের প্রায় সব বিষয়েই প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন। নারী দিবসকে সামনে রেখেই কথা হয় গুণী এই শিল্পীর সঙ্গে। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো আলাপের চুম্বক অংশ।

জাগো নিউজ : কেমন আছেন?

শিমুল ইউসুফ : এই তো ভালো আছি।

জাগো নিউজ : মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই নিয়মিত সংগীতের সঙ্গে পথ চলা শুরু করেছেন, পরে নাটকেও মেলে ধরেছেন নিজেকে। আপনার শিল্প জীবসের শুরুর গল্পটা বলেবেন?

শিমুল ইউসুফ : আমার বাবা মেহতের বিল্লাহ গান করতেন। আমাদের পরিবারেই সংগীত চর্চা বিষয়টি ছিল। সেই সুবাদেই গান শেখার সুযোগ হয়েছে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই। ১৯৬২ সাল থেকেই শিশুশিল্পী হিসেবে রেডিওতে গান গাইতে শুরু করি। আমার গানের হাতে খড়ি হয় কচি কাঁচার মেলা থেকে। স্টেজ পারফর্ম করেছি আগেই কচি কাঁচার মেলার আয়োজনে। ১৯৬২তে রেডিওতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হই, ছোটদের আসরের জন্য।

জাগো নিউজ : ১৯৭৪ সালে ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিলেন তখন আপনার বয়স মাত্র ১৭। প্রশ্নটা হচ্ছে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশটা কেমন ছিল? বিশেষ করে নারীদের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রটা তখন কেমন ছিল?

শিমুল ইউসুফ : অনেক ভালো ছিল। যেই কারণে আমরা তিন বোন তিন মাধ্যমে কাজ করতে পেরেছি। ওই সময় একটা মুসলিম পরিবার থেকে আমরা যে গান নাটক নাচ যেটাই করেছি। বাধাগ্রস্ত হইনি কখনো। সাংস্কৃতিক পরিবেশ নির্ভর করে তো তার সামাজিক অবস্থানের উপর। আমরা কমলাপুরে যেই জাইগাতে বেড়ে উঠেছি। সেই পরিবেশটা শিল্প সংস্কৃতির অনুকূলেই ছিল। সেখানে বড় বড় লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, জহিরুল হক, বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের নির্মাতা আব্দুল জব্বার খানের মতো মানুষরা থাকতেন। উনার সবগুলো মেয়েও গান করতেন। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই মিলে মিশেই তো আমরা ওই পাড়াতে থাকতাম। আসলে যারা শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে তারা কখনই বাধাগ্রস্ত হয়নি।

জাগো নিউজ : আমরা একটা প্রচলিত কথা শুনে আসছি, নারীদের জন্য শিল্প সংস্কৃতির কাজ করাটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জ ছিল। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?

শিমুল ইউসুফ : সেটা তো যার যার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে তাই না। কে কী করবে। তখনকার দিনে ফেরদৌসী রহমানও গান গেয়েছেন, ফেরদৌসী মজুমদারও অভিনয় করেছেন, বিখ্যাত লেখকরা লিখেছেন। এটা নির্ভর করে যার যার ইচ্ছার উপর। যারা শুধুই সংসারি হতে চেয়েছেন তারা সংসারি হয়েছেন। আমরা শিল্প সংস্কৃতিক পরিবারে যেহেতু বেড়ে উঠেছি, কাজেই আমরা সেই সুযোগ পেয়েছি। আমার মা তো বলতেনই ‘শিল্প সংস্কৃতির চর্চা না করলে মানুষ হওয়া যায় না।’

shimul-yousuf-2

জাগো নিউজ : নজরুল গীতি, লালন গীতি, উচ্চাঙ্গ সংগীত, গণসংগীত গেয়েছেন গানের তো দিকে নিজেকে ছড়ালেন কীভাবে?

শিমুল ইউসুফ : ক্লাসিক্যাল শিখলেই আসলে সব ধরনের গান গাওয়া যায়া। ক্লাসিক্যাল শিখে গলার ভিত্তি তৈরি করতে হয়। আমি ক্ল্যাসিক্যাল শিখেছি। সব ধরনের গান গেয়েছি। পরে যখন আমার বড় বোনের জামাই হয়ে আলতাফ মাহমুদ আসলেন। তখন তার কাছে গানের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক শিখেছি। হাতে কলমে শিখিয়েছেন। তখন আমি শিখেছি, নজরুল সংগীত একভাবে গাইতে হয়, রবীন্দ্রসংগীত আরেকভাবে গাইতে হয়, লালন গীতির ও ফোকের আলাদা আলাদা মেজাজ। উচ্চাঙ্গ সংগীত আরেকভাবে। এই শিক্ষাটার পুরো কৃতিত্বই শহীদ আলতাফ মাহমুদের।

জাগো নিউজ : সংগীতে তো ডিপ্লমাও করেছেন-

শিমুল ইউসুফ : হ্যাঁ। আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন থেকে ডিপ্লমা করেছিলাম। আমি ছায়ানটে খুব ছোটবেলায় দুই বছর গান শিখেছি।

জাগো নিউজ : পরে শিল্পী পরিচয় ছাপিয়ে আপনি অভিনেত্রী হিসেবেই বেশি আদরণীয় হয়েছেন। একটা সময় কি গানের চেয়ে অভিনয়েই নিজেকে মেলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

শিমুল ইউসুফ : না, ঠিক তেমন নয়। গান আমার রক্তে আছে। ওখান থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না। কিন্তু মঞ্চে আমি যে কাজটি করি, অভিনয়। সেটা পরে আমাকে আকৃষ্ট করেছে, নেশাগ্রস্ত করেছে। এর কারণ এক সেলীম আল দীনের লেখা আমাকে অসম্ভব টানে, অন্যদিকে নাসিরুদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় কাজ করেছি একটার পর একটা নাটকে। এই দুইজন মানুষ নাটকে আমাকে প্রভাবিত করেছে। এই কারণেই নাটকে আমি এত বেশি করে ঝুঁকেছি।

জাগো নিউজ : প্রায় ৩৩টির অধিক নাটকে অভিনয় করা, ১৬০০ এর অধিকবার মঞ্চায়ন করেছেন আপনি?

শিমুল ইউসুফ : সংখ্যাটা হয় তো আরও বেশি হবে।

জাগো নিউজ : ইংল্যান্ডের শেক্সপিয়ার গ্লোব থিয়েটারে বাংলায় ‘টেম্পেস্ট’ নাটক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন আপনি। সেই মঞ্চের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন?

শিমুল ইউসুফ : ওইটা আসলে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যারা আমাদের দুইশ বছর শাষণ করে গেছিল। সেই ইংল্যান্ডেরর গ্লোব থিয়েটারে বাংলায় নাটক মঞ্চায়ন করছি। সেখানে গিয়ে আমরা কতটা পারঙ্গম সেটা উপস্থাপন করছি। সেই পারফর্মের সময় ভেতরে যেই উদ্দীপনাটা ছিলো, এটা আমার সারা জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দর্শকও অসম্ভব ভালো ছিল। ওরাও অ্যাপ্রিসিয়েট করেছে। আর আমাদের এখানে তো দর্শকরা টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে। তখন তারা ভালো মতো হাত তালিও দেয় না। তাই না। আর ওখানে অভিনয়ের প্রতিটা অংশেও ওরা হাত তালি দিয়েছে। আমাদের দুটো শোই অধাসাধারণ ভালো হয়েছে।

জাগো নিউজ : আমাদের শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গণের পুরো ধারাবাহিকতার সাক্ষী হয়ে আছেন, ধীরে ধীরে আমাদের থিয়েটারের বিবর্তন নিয়ে যদি কিছু বলবেন?

শিমুল ইউসুফ : আমাদের মহিলা সমিতির, এবড়ো থেবড়ো মঞ্চ, ভাঙা তক্তা, পা কেটে যেত তক্তার উপর হাঁটলে। যখন বনপাংশুল করি হাঁটু ছিলে ঘা হয়ে গেছিল, সেখান থেকে আমাদের পারফরমাররা আজকের শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে অভিনয় করছে। নতুন প্রজন্ম। আর ফ্রাইড হাউসে অভিনয় করতে গেলে ছাদ থেকে পলেস্তরা খসে পড়তো। সেই জাইগা থেকে আজকে আমারা কোথায় এসেছি, সেটা যদি আজকের প্রজন্ম একটু অনুভব করে, তাহলে বুঝব আমাদের কষ্টের সার্থকতা আছে। কিন্তু যদি মনে করে এই রকমই ছিল সব কিছু, তাহলে আই অ্যাম স্যরি। কিছুই বলার নাই।

shimul-yousuf-3

জাগো নিউজ : থিয়েটার কর্মীরা অনেক সম্মান পায়, থিয়েটার কর্মী শুনলে মানুষ সম্মান করে। কিন্তু পেশাদারিত্বের জাইগাটা এখনো আসেনি থিয়েটারে, পাশের দেশ ভারতেই থিয়েটার কর্মীরা সরকারি ভাতা পায়। আমরা কেন সেই জাইগাতে নিতে পারিনি আমাদের থিয়েটারকে?

শিমুল ইউসুফ : আমি এই বিষয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর এসব বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। কারণ ২০-২৫ বছর ধরে আমি এটাই বলছি। সরকারি অনুদান ছাড়া থিয়েটার বেজড কোনো পারফরমারকে ধরে রাখা যাবে না। এবং তাই হয়েছে আমাদের থিয়েটারে। আমরা কোনো ভালো পারফরমারকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমরা তাদেরকে পে করতে পারি না। তরা মিডিয়া মুখি হয়েছে, ভালো পয়সা উপর্জন করছে। এখানে যদি সরকার দৃষ্টি না দেন, তাহলে এই থিয়েটার কতদিন চলবে আমি জানি না।

এখনো শিল্পকলায় বিনা দর্শনীতে মাঠে ওপেন শো হচ্ছে। সেখানে দর্শকরা অনুষ্ঠান উপভোগ করছে বিনা টিকিটে। সেখানে আমাদের নাটক কেন দর্শক টিকিট কেটে দেখবে। এটা যদি বন্ধ না হয় তাহলে থিয়েটার টিকে থাকবে না।

জাগো নিউজ : এই সরকারের জাতীয় সংসদের নতুন অধিবেশনে অভিনেত্রী, এমপি সুবর্ণা মুস্তাফা বলছিলেন, শিল্পী পেশা হিসেবে স্বীকৃত না হওয়া শিল্পীরা ব্যাংক থেকে ছোট্ট একটা লোনও নিতে পারেন না। এত দিন পরে সংসদে উঠল বিষয়টি?

শিমুল ইউসুফ : আমি শুনিনি অবশ্য। আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংশ করেছি, আমরা নিজেরাই নিজেদের বঞ্চিত করেছি। সুবর্ণাও মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে প্রায় ২০-২৫ বছর হবে।

জাগো নিউজ : শেষ প্রশ্ন, বছরে একটা দিন আমরা নারী দিবস পালন করি। এই দিনে সমস্ত নারী, বিশেষ করে আমাদের দেশের নারীদের উদ্দেশে আপনি কী বলতে চান?

শিমুল ইউসুফ : আমি আসলে কখনই নারী পুরুষ ওইভাবে বিভাজন করি না। আমি এই বিভাজনেই যাই না। আমি মানুষকে ভালোবাসি, মানুষকে শ্রদ্ধা করি। যেদিন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মানুষ এই বোধটা সবার মধ্যে আসবে। তখন ভাববো আমরা বিজয়ী। নারী দিবস ও ম্যান দিবস এগুলা আমি বিশ্বাসই করি না।

এমএবি/পিআর

আরও পড়ুন