গুরুর একুশে পদক পাওয়া ব্যান্ড সংগীতের জন্য মাইলফলক : আরমান খান
‘পপ সম্রাট আজম খানকে একুশে পদক দেওয়া হোক’ এই দাবি উঠেছিল অনেক দিন আগে থেকেই। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের ভক্তকুলদের সেই দাবি পূর্ণ হলো। এবার মরণোত্তর একুশে পদক পাচ্ছেন আজম খান। তার গাওয়া ‘বাংলাদেশ’, ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’ এর মতো অসংখ্য গান এখনো হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।
বাংলা সংগীতের এই প্রাণপুরুষ এখনো বেঁচে আছেন কোটি কোটি হৃদয়ে। আজম খানের একুশে পদক প্রাপ্তিতে অনেক বেশি খুশি হয়েছেন দেশের সংগীতপ্রেমী সকল মানুষ। বাংলাদেশের ব্যান্ড শিল্পীদের মধ্যে উনিই প্রথম একুশে পদক পেলেন।
আজম খানের মেজ ভাই আলম খানের ছেলে এক সময়ের জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক আরমান খান জাগো নিউজকে বলেন,‘ব্যান্ড শিল্পীরা অনেকেই চেয়েছিলেন আজম খানকে একুশে পদক দেওয়া হোক। আমি ফেসবুকে দেখেছি, অনেকেই লিখেছেন এই বিষয়ে। সরকার এই বিষয়টিকে গুরত্ব দিয়েছেন। উনি এই পুরস্কারের যোগ্য ছিলেন। উনার একুশে পদক প্রাপ্তির খবর শুনে অনেক ভালো লাগছে।’
আরমান খান আরও বলেন, ‘উনি বেঁচে থাকলে নিজেই পুরস্কারটি গ্রহণ করতে পারতেন। তবে এই বিষয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি অনেক আনন্দিত। আমার মনে হচ্ছে। যেহেতু, উনি বাংলাদেশে ব্যান্ড গানের প্রবর্তক, গুরু। প্রথমেই গুরু এই পদক পেয়েছেন। জুরি বোর্ডে যারা ছিলেন, তাদের অনেক ধন্যবাদ জানায়। একটা নতুন দিগন্তের শুরু করলেন তারা। সামনে আরও অন্য ব্যান্ড শিল্পীরাও এই পুরস্কার পাবেন হয় তো।’
দেশীয় ফোক ফিউশনের সাথে পাশ্চাত্যের যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে বাংলা গানের এক নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন আজম খান। সেই ধারায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এ দেশীয় ব্যান্ড সংগীত। অনেকে তাকে বাংলাদেশের বব মার্লে বা বব ডিলান বলেও সম্মানিত করে থাকেন।
১৯৫০ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। বাবার নাম আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও মা জোবেদা খাতুন। তার শৈশবের পাঁচ বছর কাটে আজিমপুর কলোনিতে। তারা ৪ ভাই ও এক বোন ছিল।
১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানালে সেখানে চলে যান পরিবারসহ। কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তার মুক্তিযুদ্ধের একান্ত সহযোদ্ধা ছিলেন সাবেক ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব সাদেক হোসেন খোকা।
পপগুরু আজম খান ১৯৭০ সালে ‘উচ্চারণ’ নামে একটি ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭২ সালে প্রথম স্ট্রেজ প্রোগ্রাম করেন নটরডম কলেজে এবং একই সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান করেন। তবে ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল ওয়াপদা মিলনায়তনের অনুষ্ঠানই তাকে খ্যাতিমান করে তোলেন।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত প্রথম একক এ্যালবাম ’এক জনম’। তিনি একে একে ১৬৮টি একক গান ৩০টি মিক্সস গান সহ ১৪টি এ্যালবামের মাধ্যমে শ্রোতাদেরকে অসংখ্যা জনপ্রিয় গান উপহার দেন।
এই প্রতিভাবান সাহসী, নিরহঙ্কার, গুনী মুক্তিযোদ্ধা, সংগীত শিল্পী ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে পরাজিত হন গত ২০১১ সালের ৫ জুন। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। পারিবারিক জীবনে তিনি ২ কন্যা ইমা এবং রিমা ও পুত্র হৃদয়ের জনক।
উল্লেখ্য, আজম খানসহ আরও জনপ্রিয় দুই কণ্ঠ শিল্পী সুবীর নন্দী, খায়রুল আনাম শাকিল শিল্পকলা ও সংগীত বিভাগে একুশে পদক পাচ্ছেন এবার। শুধু গানের জগতের মানুষ নয়, অভিনয় জগতের তিন খ্যাতিমান ব্যক্তিও একুশে পদক পাচ্ছেন। শিল্পকলা অভিনয় বিভাগে এবার একুশে পদক পাচ্ছেন লাকী ইনাম, সুবর্ণা মুস্তাফা ও লিয়াকত আলী লাকী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি চলতি বছর (২০১৯) একুশে পদক পাচ্ছেন এবার।
বুধবার সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে পদক তুলে দেবেন।
এমএবি/এলএ/এমএস