আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার
মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারতেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। যতবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে সংগীতের মতোই সুন্দর মনের মানুষ হয়েছে তাকে। তরুণ প্রতিভাবানদের সঙ্গে তার চলা ফেরা আচার ব্যবহারও মুগ্ধ হওয়ার মতই ছিল। নিজের ব্যক্তিগত পরিবারের বাইরেও বাংলাদেশের পুরো সংগীতাঙ্গণকেই নিজের পরিবার মনে করতেন শৈল্পিক হৃদয়ের এই মানুষটি।
ক্লোজআপ ওয়ান অনুষ্ঠানে সালমার গান শুনে তার সন্তান হতে চেয়েছিলেন। পরেও দেখা গেছে সালমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবেসেছেন তিনি। এই সারল্য তার শুধু সালমার
বেলাতেই নয়, অসংখ্য তরুণ শিল্পীদের নিজের সন্তানের মতই আগলে রাখতেন তিনি। যারা গানকে ভালোবাসতো সবাইকেই কাছে টানতেন তিনি।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও সরব থাকতেন সব সময়। নতুন প্রজন্মকে সুপথ দেখাতেন। সুপরামর্শ দিতেন। সত্যিকারের ভালো শিল্পীরা এগিয়ে আসুক ভালো গান উপহার দিয়ে দেশের সংগীতাঙ্গণকে সমৃদ্ধ করুক এমনটাই চাইতেন সব সময়।
প্রায় চারমাস আগে কথা হয় তার সঙ্গে। দীর্ঘ সময় কথা বলেছিলেন এই সময়ের গান নিয়ে। একটি নিউজের কমেন্ট আকারের ছাপা হয়েছিল তার কিছু অংশ। তরুণদের প্রতি তার মান-অভিমান, পরামর্শ সবই ছিল তারা কথামালায়।
তরুণ শিল্পীরা সেই কথাগুলো মেনে চললে ভালো করতে পারবেন আগামীতে। গেল বছরের ১ সেপ্টেম্বর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য।
জাগো নিউজ : কেমন আছেন আপনি?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আমি ভালো আছি।
জাগো নিউজ : একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আপনার কি একটু সময় পাওয়া যাবে?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : বলো।
জাগো নিউজ : একটা বিষয় লক্ষনীয়, এখন যেই হারে নতুন গান প্রকাশ হয়, সেই তুলনায় জনপ্রিয় গান বের হয়ে আসে কম। আবার পুরনো অনেক গান এখনো জনপ্রিয় হয়ে আছে। নতুনরা সেইসব গান গেয়ে পরিচিতি পাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে বলে মনে করেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আমিও এটা লক্ষ্য করেছি, বুঝেছো। আমি এসব লক্ষ্য করি না তা কিন্তু না। দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ শিল্পী যারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে এসেছে, তারা অনেক ভালো গায় এবং শিল্পী হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
এদের মধ্যে অনেকেই আছে বছরের পর বছর আগের গানগুলোই গেয়ে যাচ্ছে। গানগুলোতে কিছুটা নতুনত্ব আনছে। এরপর এসব গান দিয়েই মানুষের সামনে আসছে। আমরা ধরে নিচ্ছি এটাই একটা ট্রেন্ড। নতুন গানের প্রতি মনযোগ কমে যাচ্ছে সবার। ভালো গান নেই তাই পুরনো গানই ভরসা শ্রোতা ও শিল্পীদের।
জাগো নিউজ : তারা কী আসলে ঠিক পথে হাঁটছে বলে মনে করছেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : অবশ্যই না। এটা ঠিক না। তাদের অবশ্যই মৌলিক গান থাকা উচিৎ। তাদের মৌলিক গানের প্রতি যত্নবান হতে হবে। তার একটা পরিচয় থাক উচিৎ সে কোন গানের শিল্পী। কারণ শিল্পী তো পরিচিত হয় তার গান দিয়ে।
একজন শ্রোতা তার গান শুনেই তাকে শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। তারপর না সে শিল্পী হবে। পরের গান গেয়ে একজন শিল্পী কীভাবে হয়? এটা আমারও প্রশ্ন। অথচ কাভার সং গেয়েই নামের আগে তারা শিল্পী লিখছে। অথবা তাদের কর্মকাণ্ড দেখে বোঝা যাচ্ছে গায়ক গায়িকার চেয়েও উপরের কোনো লেভেলে আছে সে।
জাগো নিউজ : তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আসলে মূল সমস্যা হলো গান যখন কেউ কম্পোজিশন করাচ্ছে। দেখা গেল এটা সে অনেক টাকা খরচ করেই করলো। সেই গানটার ভিডিও বানাতে গিয়ে খরচ করছে ২ লাখ-৩ লাখ টাকা। কোনো কোনো গানে নাকি ১০ লাখেরও বেশি খরচ করে।
যখন এই গানের কোনো ফিডব্যাক হয় না তখন শিল্পীরা নিরাশ হয়ে যায়। যেই টাকাটা গানের পেছনে খরচ করা হলো, সেই টাকাটা যদি ফিরে আসতো এবং সুনামও হতো তাহলে সেই শিল্পীর থেকে আমরা আরও গান পেতাম। শিল্পীরা শো করে টাকা উপার্জন করে নতুন গানের ভিডিওতে খরচ করছে।
এরপর সেই গান কেউ শুনলে শুনলো, না শুনলে না শুনলো। কোনো মাথা ব্যথা থাকে না। কিন্তু অনেক ভালো শিল্পীরা হতাশ হয়ে যায় ভিডিওতে ভালো রেসপন্স না পাওয়ার কারণে। এই কারণে অনেক ভালো শিল্পীরাও গান করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
জাগো নিউজ : এক্কেবারে গান হিট করছে না তাও নয় কিন্তু!
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : হ্যাঁ, প্রশ্ন আসতেই পারে অমুক গান হিট করলো কেন? শোনো, ভাইরাল অন্য জিনিস আর জনপ্রিয় গান অন্য জিনিস। একটা কিছু হুট করে ভাইরাল হয়ে গেল সেটা অন্য কথা। কিন্তু একটা ভালো গান ভাইরাল নাও হতে পারে। কিন্তু ভালো তো ভালোই তাই না।
সেই ভালো কিছু করতে গিয়ে যখন নিরাশ হচ্ছে শিল্পীরা তখন গান করা তারা বন্ধ করে দিচ্ছে। সহজে যেটা পাওয়া যায় সেটার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটা গান ১৬ কোটি ৩২ কোটি ভিউ হোক সেটা আমরাও চাই। আমাদের সময় তো এই সব ছিল না। কিন্তু চাই মানে যা তা গানের ভিউ আশা করে না কোনো সমাজ। কারণ গান সমাজকে প্রভাবিত করে।
আমরা যেই সব গান করেছি, যেমন সব ক’টা জানালা খুলে দাও না। এই গানটা কে শোনোনি বলো। এটা ভিউয়ের বিচার করলে হবে? যেটা ছড়ানোর সেটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাবে। একটা দেশের গান সব ক’টা জানালা; গানটা একটা শিশুর কাছে যেমন, এটা বৃদ্ধের কাছে তেমন, সরকারের কাছে যেমন, বিরোধী দলের কাছেও তেমন। গানটা প্রত্যেকটা মানুষ জানে।
গানটাকে শ্রদ্ধা করে। নিজের মতো করে ফিল করে, ব্যাখ্যা করে। এটা একটা জনপ্রিয়তা। ভাইরালও একপ্রকার জনপ্রিয়তা। মানুষ শুনছে, আবার ভুলে যাচ্ছে। যে গান মানুষের হৃদয়ে বসে না সেই গান কোনো গানই না।
জাগো নিউজ : আমাদের নতুন জেনারেশন তবে এই সংকট কাটাবে কেমন করে?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আসলে এ কোনো সংকট নয়। সহজেই অনেক টাকা আয় করে ফেলছে মাত্র। শিল্পী না হয়ে উপার্জন করাটাতে ফোকাস পড়ে গেছে। আমাদের আগের শিল্পী বা আমরা এতো সহজে টাকা উপার্জন করতে পারিনি। তখন এতো মিডিয়া ছিল না। আমরা সাধনা করেছি একটা পর্যায়ে যাবার। তারপর অর্থ বিত্ত নিয়ে ভেবেছি।
আমরা যখন ফিল্মে সুযোগ পেতাম তখন অর্থ আসতো। সিনেমায় জনপ্রিয় গান দিয়ে টাকা উপার্জন করতে পারতাম। সাবিনা আপা (সাবিনা ইয়াসমিন) রুনা আপাদের মতো (রুনা লায়লা) শিল্পীদেরও সিনেমার দিকে চেয়ে থাকতে হতো। বছরে হয়তো দুই একটা শো তারা করতেন। কিন্তু সিনেমাই ছিলো মূল জায়গা।
কিন্তু এখন? সিনেমার অবস্থা করুণ। শিল্পীদের জন্য অনেক বড় একটা প্লাটফর্ম দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবাই তাকিয়ে থাকে ইউটিউবের ভিউ আর বিদেশের ট্যুরে। ফলে কী হচ্ছে, যেসব গানে সহজে লাভবান হওয়া যাচ্ছে সেসব গানেই হচ্ছে। চটুল কথার।
আর না হলে পুরনো হিট গান তো আছেই। রিমেক হচ্ছে। বা হঠাৎ বিদেশে শো’য়ের প্রস্তাব আসলে এখনকার শিল্পীদের পুরোনো দুই একটা গান জানা থাকলেই হলো। ওরা সাবিনা আপা, রুনা আপাদের মতো কোনো সংকটের মুখে পড়েইনি। উনারা যে স্ট্রাগল করেছেন সেটা তো ভাবতেও পারবেন না। তারা বাই ফিল্ড গান গেয়ে সবার মন জয় করে তবেই হাতে এসেছে ৫-১০ হাজার টাকা। ওরা অনেক কষ্ট করেছে।
আর এখন, একটু গান জেনেই করে করে খাচ্ছে সবাই। নিজের গান না থাকলেও গাড়ি বাড়ি সব আছে।
জাগো নিউজ : এটা সত্যি বেদনাদায়ক। মৌলিক গানের চেয়ে অর্থের প্রতিই মনযোগ বেশি...
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি ওদের মনোনিবেশ কম। আমরা গাড়ি বাড়ি করতে পারিনি। আমরাও পারতাম। অনেক সুযোগ ছিলো। কিন্তু আমরা শুধু সৃষ্টি করে গেছি। অভাবও সঙ্গে রয়ে গেছে। কারণ যতটুক আমাদের খাদ্য দরকার ততটুকুই আমরা চেয়েছি। এর বাইরে কিছু করতে প্রত্যাশা করিনি। এখন তো অনেক চাহিদা। এত চাহিদা শিল্প বাঁচাবে কী করে!
এখন একটা গানের সুর, সংগীতায়োজন করতে ২ লক্ষ টাকাও নাকি নেয় অনেকে। আবার ভিডিও করতে ২-৩ লাখ টাকা লাগে। কেন একটা গানের সুর সংগীত করতে ২-৩ লক্ষ্য টাকা লাগবে আমার বুঝে আসে না। কতো বড় মাপের সুরকার সে এতো টাকা নিবে। একটা লোকের যদি ১০০টা জনপ্রিয় গান থাকে সে ডিমান্ড করতে পারে ৫০-৬০ হাজার টাকা।
গতকাল কাজ শিখেছে আজকেই নাকি তার পেমেন্ট ২ লাখ টাকা। তা এত দামের গানের মানুষ, গান কোথায় আমাদের? নতুন শিল্পীরা এইসব দেখে-ভেবেই আর সাহস পায় না। তারা কীভাবে গান করবে! সত্যিকারের শিল্প সাধনা করে এমন অনেক মেধাবী আছে আমাদের। আশেপাশেই তাদের বিচরণ। প্রমোট করলেই তারা বের হয়ে আসবে।
জাগো নিউজ : সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : তোমাকেও ধন্যবাদ।
এমএবি/এলএ/আরআইপি