ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

নায়ক হয়ে এসে ভিলেন হিসেবে দেশ কাঁপিয়েছিলেন রাজীব

লিমন আহমেদ | প্রকাশিত: ০২:৩৪ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

শক্তিমান অভিনেতা তিনি। তার বাঘের মতো সংলাপ পর্দায় কাঁপন ধরাতো। তার ভযংকর সব অঙ্গভঙ্গির ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়েছেন এ দেশের বহু মা। সিনেমায় কুটবুদ্ধি, প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী মোকাবিলায় ঘায়েল করতে জুড়ি ছিলো না তার। অভিনয়ে যেমন ছিলেন দুর্দান্ত, তেমনি তার বাচনভঙ্গি, এক্সপ্রেশনও ছিলো যে কোনো অভিনেতার জন্য ঈর্ষনীয়।

তিনি রাজীব। সবার প্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা রাজীব। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। চলচ্চিত্রপাড়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।

পর্দা নাম রাজীব। মূলনাম ওয়াসিমুল বারী রাজীব। জন্ম ভাষা আনদোলনের বছরে ১৯৫২ সালে। তারিখ ১ জানুয়ারি। পটুয়াখালী জেলার দুমকিতে।

চলচ্চিত্র পাড়ার বিভিন্ন সমিতিগুলোতে খোঁজ নিয়ে ও অনলাইন ঘেঁটে পাওয়া গেল তার কিছু তথ্য। সেইসব তথ্য চমকে দেবে যে কোনো সিনেমাপ্রেমী মানুষকে। অভিনয়ে-ব্যাক্তিত্বে, রুচি ও মূল্যবোধে অনন্য এক রাজীবের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তেমন করে তাকে চেনেন না।

রাজীব পড়াশোনা করেছেন গ্যাস টেকনোলজি বিষয়ে। তিনি কর্মজীবনও শুরু করেছিলেন গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে। তিতাস গ্যাস কোম্পানির কর্মী ছিলেন তিনি।

বেতার, মঞ্চ ও টিভি অভিনেতা ছিলেন। তার উচ্চারণ ছিলো সুষ্পষ্ট ও শুদ্ধ। রাজীবের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তার কণ্ঠ। কণ্ঠের দরাজ অভিব্যক্তি দর্শককে মুগ্ধ করত। দরাজ কণ্ঠে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর’ ছবিগুলোতে আহমেদ শরীফের সাথে রাজিবের অভিনয়ের অংশগুলো স্মরণ করলেই বোঝা যাবে। ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবিতে অমর নায়ক সালমান শাহর সাথে রাজা-প্রজার জবাবদিহির সময় খোলা মাঠের তর্কের দৃশ্যটি মনে করলেও বোঝা যায় তার ভরাট কণ্ঠের জাদু।

তিনি সবসময় সিনেমার চিত্রনাট্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শুটিং সেটে মেনে চলেছেন পরিচালকের নির্দেশনা। অভিজ্ঞতা ও আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করতেন না এই অভিনেতা, এমনটাই জানালেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতৃবৃন্দ। নিজের চরিত্র যেমনই হোক সেটা নিয়ে বারবার রিহার্সেল করতেন। ছাড়িয়ে যেতে চাইতেন সিনেমার অন্য সব চরিত্রগুলোকে।

শিল্পীরাও পছন্দ করতেন তাকে। শিল্পীদের নানা বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহকে তিনি ছেলে মনে করতেন। সালমান শাহও রাজীবকে সিনেমা অঙ্গনের বাবা বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। শিল্পীদের ভালোবাসা নিয়ে শিল্পী সমিতির নেতৃত্বও দিয়েছেন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে। এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও হয়েছিলেন এই অভিনেতা।

ভিলেন হয়ে তুুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। অথচ মজার ব্যাপার হলো ঢালিউডে তার আগমন ঘটেছিলো নায়ক হিসেবে। ১৯৮১ সালে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ ছবিতে প্রথম তিনি নায়ক হয়ে অভিনয় করেন। তবে তিনি তারকাখ্যাতি পান কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘খোকনসোনা’ ছবিতে অভিনয় করে। ছবিটিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন কাজী মারুফ।

এছাড়া ‘দাবি’ নামের আরেকটি ছবিতেও নায়ক ছিলেন। আশির দশকের শেষদিকে তিনি ভিলেন হিসেবে যাত্রা করেন। সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় ভিলেন হিসেবেই তিনি থিতু হন।

পজেটিভ চরিত্রেও রাজীব ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভালো চরিত্রে হাজির হয়ে রাজীব দর্শক হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন বারবার। বিশেষ করে ‘স্নেহের প্রতিদান’ ছবিতে অভিনেতা রাজীবের অভিনয় ছিলো অনিন্দ্য। সে ছবি যারা দেখেছেন তাদের রাজীবের কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিলো অবলীলায়। এছাড়াও ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘জিদ্দি’, ‘অপরাজিত নায়ক’, ‘অন্ধ ভালোবাসা’, ‘ঘায়েল’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘অন্যমানুষ’ ইত্যাদি ছবিতেও ইতিবাচক চরিত্রে দর্শক মাতিয়েছিলেন রাজীব।

তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে- বিদ্রোহী, পরাণপাখি, জীবনধারা, ভাত দে, মানিক রতন, সম্রাট, শক্তি, মায়ের দাবি, যন্ত্রণা, রাজভিখারি, নকল শাহজাদা, বেরহম, মিয়াভাই, হিসাবনিকাশ, আন্দাজ, অহিংসা, পুষ্পমালা, জারকা, নবাব, সাহেব, খামোশ, উসিলা, দাগী, কাবিন, আওয়াজ, আয়নামতি, চাচা ভাতিজা, চন্দনা ডাকু, অবিশ্বাস, নিয়ত, হীরামতি, চাঁদাবাজ, দাঙ্গা, বিদ্রোহ চারিদিকে, রক্তের বদলা, দেশদ্রোহী, মীরজাফর, হিংসার আগুন, শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা, বুকের ভিতর আগুন, সত্যের মৃত্যু নেই, প্রেম দিওয়ানা, অপরাজিত নায়ক, জিদ্দি, ডন, বাবার আদেশ, স্নেহের প্রতিদান, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের ঠিকানা, স্বপ্নের পৃথিবী, অন্তরে অন্তরে, বিক্ষোভ, মহামিলন, বিদ্রোহী আসামী, সত্য মিথ্যা, হুমকি, বীরাঙ্গনা সখিনা, মা মাটি দেশ, প্রেম প্রতিজ্ঞা, টাকার অহংকার, শয়তান মানুষ, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যার রাজা, আজকের প্রতিবাদ, একজন বিদ্রোহী, প্রিয় তুমি, বিদ্রোহী কন্যা, বিদ্রোহী সন্তান, লক্ষীর সংসার, প্রেম বিরহ, শেষ রক্ষা, ঘায়েল, হাঙর নদী গ্রেনেড, বন্ধন, জবরদখল, আখেরি রাস্তা, চালবাজ, বিদ্রোহী প্রেমিক, বীরযোদ্ধা, ওমর আকবর, ছলনা, দিনকাল, লজ্জা, বাঘিনী কন্যা, মাতৃভূমি, প্রেম যমুনা, শেষ পরিচয়, আদেশ, শেষ যুদ্ধ, মহান বন্ধু, ডিস্কো ড্যান্সার, আত্মরক্ষা, সন্ধান, জিদ, লাভ, ডন, আজকের সন্ত্রাসী, দুর্জয়, ত্রাস, ক্ষমা, লুটতরাজ, দেমাগ, দেশ দরদী, অন্ধ বিশ্বাস, সত্য মিথ্যার লড়াই, মহা সংগ্রাম, মৃত্যুদাতা, আর্তনাদ, নয়ন ভরা জল, মেয়ের অধিকার, মিস ডায়না, গোলাপি এখন ঢাকায়, অন্ধ ভালোবাসা, বেপরোয়া, ভয়ঙ্কর সাতদিন, চোরের বউ, চাকর, স্ত্রীর পাওনা, ন্যায়যুদ্ধ, রাজার মেয়ে বেদেনী, আপন পর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যোগাযোগ, জাদুমহল, আদিল, স্বামী-স্ত্রী, চাঁদের আলো, মহৎ, বিসর্জন, আত্মত্যাগ, আজকের হাঙ্গামা, খলনায়ক, যোদ্ধা, ভণ্ড, বিপ্লবী জনতা, মগের মুল্লুক, গুণ্ডার প্রেম, বিশ্ব বাটপার, জুম্মন কসাই, আব্বাজান, বলো না ভালোবাসি, গুণ্ডার প্রেম, বিশ্ব বাটপার, মেঘের পরে মেঘ, মেঘলা আকাশ, অন্যমানুষ, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, বলো না ভালোবাসি, হৃদয়ের বন্ধন, প্রেমের তাজমহল, আগুন জ্বলবেই, ভালোবাসা কারে কয়, ভালোবাসি তোমাকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভাইয়া, বাঘের বাচ্চা, খতম, পড়ে না চোখের পলক, ভালোবাসার দুশমন, মায়ের সম্মান, স্বপ্নের বাসর, স্বপ্নের পুরুষ, জামাই শ্বশুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অভিনেতা রাজীব চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও সফল হয়েছেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রেন্ডস মুভিজ। বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তিনি উপহার দিয়েছেন প্রযোজক হিসেবে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রাজীব চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার ভূমিকায়। ‘হীরামতি’ ছবি দিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রথম পুরস্কার ঘরে তুলেন তিনি। এরপর ১৯৯১ সালে ‘দাঙ্গা’, ২০০০ সালে ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’, ২০০৩ সালে ‘সাহসী মানুষ চাই’ ছবির জন্য পুরস্কার পান।

অভিনেতা রাজীব; মৃত্যুর ১৪ বছর পেরিয়েও এতটুকু ম্লান হননি শ্রদ্ধা ও স্মরণের জায়গায়।
মিডিয়ার গ্ল্যামার আর কর্পোরেট বাণিজ্যে তার চাহিদা না থাকলেও তিনি থেকে যাবেন ঢাকাই সিনেমার কয়েক প্রজন্মের দর্শকের মনে, চলচ্চিত্রের সবখানে। মাত্র ৫২ বছরেই জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া এই কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সূত্র : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও অনলাইন

এলএ/আরআইপি

আরও পড়ুন